স্পারসো: মহাকাশ গবেষণায় কতটা পারছে অবদান রাখতে? | Sparrso

Written by : Tanvir Mahatab Abir

 




আপনার যদি মহাকাশ গবেষণা নিয়ে নূন্যতম ধারণা থেকে থাকে, তাহলে ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (নাসা) নাম নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি এই সংস্থাটি মহাকাশ গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। নাসার মতো বিভিন্ন দেশেই মহাকাশ গবেষণায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। এই দেশেও তেমনই একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। নাম বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান, সংক্ষেপে 'স্পারসো'। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত। 


শুরুর গল্প 


সময়টা গত শতাব্দীর ষাটের দশক। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি পরমাণু গবেষণাগারে কর্মরত কয়েকজন ঊর্ধ্বতন বাংলাদেশী বিজ্ঞানী ঢাকায় 'পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র' নামে পদার্থ, রসায়ন, ইলেক্ট্রনিক্স, কম্পিউটার, কৃষি, বিকিরণ ও তেজস্ক্রিয় জীববিজ্ঞান, নিউক্লিয়ার মেডিসিন এবং স্বাস্থ্য পদার্থবিদ্যাসহ নানান বিষয়ে গবেষণার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান চালুর উদ্যোগ নেন । এই প্রতিষ্ঠানেই ১৯৬৮ সালে একটি অটোমেটিক পিকচার ট্রান্সমিশন (APT) গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশ মহাকাশ প্রযুক্তির জগতে প্রবেশ করে। এই গ্রাউন্ড স্টেশনের মাধ্যমে আবহাওয়া উপগ্রহ থেকে সরাসরি প্রকৃত আবহাওয়া চিত্র পাওয়া যেত। 



 পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন-এ মহাকাশ ও বায়ুমন্ডলীয় গবেষণা কেন্দ্র (SARC) স্থাপন করা হয় এবং এপিটি গ্রাউন্ড স্টেশনটিকে এর আওতায় নিয়ে আসা হয়। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসা'র উদ্যোগে আর্থ রিসোর্স টেকনোলজি স্যাটেলাইট (ERTS) উদ্ভাবিত হয়। পরবর্তীতে ল্যান্ডসেট-১ নামে পরিচিতি পাওয়া এই স্যাটেলাইটটি মূলত ব্যবহার করা হতো রিমোট সেন্সিং ও ভূমির ম্যাপিংয়ের কাজে।


১৯৭৩ সালে বাংলাদেশও ইআরটিএস প্রোগ্রাম নামে একটি কর্মসূচি গ্রহণ করে। পরবর্তীতে এটির নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ ল্যান্ডস্যাট স্যাটেলাইট প্রোগ্রাম (BLP) । ১৯৮০ সালে সরকারের এক নির্বাহী আদেশে এসএআরসি এবং বিএলপি উভয়কে একীভূত করে স্পারসো অর্থাৎ বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান নামে নতুন একটি প্রতিষ্ঠান চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়।  




স্পারসোর কাজের পরিধি 


 বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ কর্তৃক ১৯৯১ সালের ২৯ নং আইনে স্পারসোকে একটি স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।



স্পারসোর আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি মূলত কৃষি, বন, ভূ-তত্ত্ব, মানচিত্র অংকন, আবহাওয়া, পরিবেশ, সমুদ্রবিজ্ঞানসহ জ্ঞান ও বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে মহাকাশ ও দূর অনুধাবন প্রযুক্তিকে শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবহার করে থাকে এবং উক্ত প্রযুক্তির উন্নয়ন ও ব্যবহারিক প্রয়োগের জন্য গবেষণা কাজ পরিচালনা করে থাকে। গবেষণা থেকে পাওয়া ফলাফল সরকার ও বিভিন্ন সংস্থাকে অবহিত করাও স্পারসোর একটি নিয়মিত কাজের মধ্যে পড়ে। 




এছাড়া মহাকাশ ও দূর অনুধাবন প্রযুক্তি সম্পর্কে বিভিন্ন দেশের নীতি সরকারকে অবহিত করা এবং সে অনুযায়ী পরামর্শ দেওয়াও স্পারসোর কার্যাবলীর মধ্যে রয়েছে। 


দেশে মহাকাশ ও দূর অনুধাবন কার্যক্রম পরিচালনার কেন্দ্র হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকে স্পারসো। মহাকাশ ও দূর অনুধাবন প্রযুক্তি সম্পর্কে সমীক্ষা, জরিপ, প্রশিক্ষণ ও কারিগরী গবেষণার ব্যবস্থা করা এবং প্রকল্প গ্রহণ করে সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষ বাস্তবায়ন করাও স্পারসোর অন্যতম কাজ। 



স্পারসোর ব্যাপ্তি কতটা? 


এরিয়াল ফটোগ্রাফ ও স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত উপাত্তের প্রক্রিয়াকরণ, বিশে­ষণ, সংরক্ষণ এবং ব্যবহারের জন্য স্পারসোর নিজস্ব প্রযুক্তিগত, প্রশিক্ষিত জনশক্তিগত ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুবিধা রয়েছে বলে সংস্থাটির ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্টের ন্যাশনাল ওশেনিক এন্ড এটমসফেরিক এডমিনিস্ট্রেশনের (NOAA) স্যাটেলাইট এবং জাপানের জিওস্টেশনারি মেটিওরোলজিক্যাল স্যাটেলাইট (GMS) থেকে উচ্চ ও নিম্ন ক্ষমতার উপাত্ত ও চিত্র গ্রহণের জন্য এই প্রতিষ্ঠানের রয়েছে উন্নত প্রযুক্তির আবহাওয়া উপগ্রহ গ্রাউন্ড স্টেশন।


স্পারসো এই উপাত্তগুলো প্রতিদিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রদান, কৃষি-জলবায়ুগত পরিবেশ পর্যবেক্ষণ এবং পানি সম্পদ সমীক্ষার কাজে ব্যবহার করে থাকে। 


আবহাওয়াগত ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংশ্লিষ্ট উপগ্রহ উপাত্তের নিখুঁত বিশে­ষণের জন্য স্পারসোর রয়েছে নিজস্ব অত্যাধুনিক ডিজিটাল চিত্র প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থা।  




স্পারসোর রয়েছে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, যাতে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রায় হাজার পাঁচেক এরও অধিক বই রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে ওয়েবসাইটে। 


এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পরিবেশ কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মহাকাশ বিজ্ঞানের প্রয়োগে জাতিসংঘের এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন (ESCAP) সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একযোগে কাজ করে সরকারি এই সংস্থাটি। স্পারসো এশিয়ান এসোসিয়েশন অব রিমোট সেনসিং-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং আন্তর্জাতিক এস্ট্রোনটিক্যাল ফেডারেশনের সদস্য।



প্রত্যাশা নাকি হতাশা - কোনটি পূরণে এগিয়ে স্পারসো? 


স্পারসো'র ওয়েবসাইটে প্রতিষ্ঠানটির দুইটি অর্জনেরকথা উল্লেখ রয়েছে। প্রথমটি, এগ্রো-ক্লাইমেটিক এনভায়রনমেন্টাল মনিটরিং প্রজেক্ট (ACEMP) এর সাফল্যজনক সমাপ্তির জন্য সংস্থাটি ১৯৮৬ সালে নাসা থেকে ‘Group Achievement Award’ লাভ করে। 


দ্বিতীয় যে অর্জনটি উল্লেখ রয়েছে সেটি বেশ অদ্ভুতুড়েই ঠেকবে আপনার কাছে। স্পারসোর প্রাক্তন চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মোছাব্বের চৌধুরী বিজ্ঞান জগতে তার অসামান্য কৃতিত্ব স্বরূপ ১৯৯৮ সালে স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তিনি স্পারসোর চেয়ারম্যান পদে ছিলেন না সে সময়। ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, তিনি এই পদে আসেন পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৯ সালের আগষ্টে। তাহলে ব্যক্তিগত এই অর্জন কীভাবে স্পারসোর অর্জন হয় সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপারই বটে।  


তাহলে কি গেল ৪০ বছরে স্পারসোর তেমন কোনো সাফল্য বা অর্জনই নেই? সাফল্য নেই - এমন বলাটা অবশ্য ভুল।  



স্পারসো বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা সংস্থাকে স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্যের বিশ্লেষণ বা আনুষাঙ্গিক পরিসংখ্যান সরবরাহ করার কাজটি করে আসছে প্রতিষ্ঠানটির সূচনালগ্ন থেকেই। সেই জায়গা থেকে বেশ সফল সরকারের এই প্রতিষ্ঠানটি। 


২০১৮ সালে বাংলাদেশ নিজেদের প্রথম স্যাটেলাইট 'বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১' উৎক্ষেপণ করে। বাংলাদেশ ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন কর্তৃক এই স্যাটেলাইট প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে। এই প্রকল্পের প্রধান কন্ট্রাক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে স্পারসো।





ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে তৈরি করা বাংলাদেশের প্রথম ন্যানো স্যাটেলাইট ‘অন্বেষা’ উৎক্ষেপণেও শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং গ্রাউন্ড স্টেশন নির্মাণে যুক্ত রয়েছে স্পারসো। 


মহাকাশসংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় মেধাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা হয় স্পারসোকে। প্রতিষ্ঠার পর আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসা'র সাথে বেশ কিছু প্রজেক্টে কাজ করেছে স্পারসো। সে সব প্রজেক্টের আওতায় কিছু ডকুমেন্টারিও তৈরি করা হয়েছিল সে সময়। কিন্তু এরপর আর নাসার সাথে কাজ করার সুযোগ হয় নি স্পারসোর। 


 পরবর্তীতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক সরকারের শাসনকালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা এই সংস্থাকে সংকীর্ণ বিবেচনায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এর ফলে মহাকাশ গবেষণা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে বিভিন্ন সময়ে সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হতে হয়েছে স্পারসোকে। কারণ, এই ঘটনার পর থেকে মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসাসহ বিদেশি সংস্থাগুলো সক্রিয় সাহায্য-সহযোগিতা বন্ধ রেখেছে।   


গেল প্রায় চার দশকের বেশি সময়ে সাফল্যের গল্পটা তাই খুব বেশি সমৃদ্ধ করতে পারে নি বাংলাদেশের মহাকাশ গবেষণার এই প্রতিষ্ঠানটি। 


প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান পরিচালক জিয়াউল হাসান স্বীকার করছেনI স্পারসোর সীমাবদ্ধতার কথা। বলছেন নাসার আদলে স্পারসোর ডিজাইন করা হলেও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি ও লোকবলের অভাবে মহাকাশ গবেষণায় অবদান রাখতে পারছে না তার প্রতিষ্ঠান৷


 স্পারসো তার নামের সাথে মিল রেখে মহাকাশ গবেষণায় কাজ করবে, সে কাজে বাংলাদেশকে সাফল্যের অংশীদার করবে- এমনটাই থাকুক প্রত্যাশা।