মাটির চুলায় বায়ু দূষণ: গ্রামীণ অভ্যাসে পরিবর্তনের হাওয়া
Written by : Tanvir Mahatab Abir
গ্রামে গিয়েছেন অথচ কারো বাসায় মাটির চুলায় রান্না দেখেন নি এমন মানুষ বোধহয় খুঁজে পাওয়া ভার। মাটির চুলায় রান্না বাঙালির আজন্মকাল ধরে চলে আসা এক ঐতিহ্যের অংশ। কিন্তু মুদ্রার উল্টোপিঠও যে আছে।
জাতিসংঘ বলছে, প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৪৯ হাজার মানুষের অকালে মৃত্যু হয় গৃহস্থালি বায়ু দূষণে, যার প্রধান উৎস মাটির চুলার ধোঁয়া।
গ্রামের চিত্রটা কি রকম?
বাংলাদেশের রংপুর জেলা সদরের গ্রাম ঘাগটপাড়া। ভোরের আলো যখন গাছপালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় গ্রাম্য উঠোনে তখনই ঘুম থেকে উঠে যান এখানকার বাড়ির কর্ত্রীরা। পঞ্চাশোর্ধ মাফরুহার দিনও শুরু হয় এমন করেই, রান্নাঘরে নানান কাজে হয়ে পড়েন মহাব্যস্ত।
![]() |
গৃহিণীদের দিনের অনেকটা সময়ই কাটে রান্নাঘরে। ছবিঃ ইডকল। |
ঘাগটপাড়া যাওয়ার পথে প্রায় দিগন্ত ছুঁয়ে থাকা অসংখ্য ইটভাটা চোখে পড়বে, অনবরত যেখান থেকে দূষিত কালো ধোঁয়া মিশছে বায়ুমন্ডলে৷ গ্রামের বাড়িগুলোয় সেই ধোঁয়ারই আচ্ছাদন মিলে, তবে সেটি ইটভাটা থেকে আসা ধোঁয়া নয়। রান্নাঘরের মাটির চুলা এই ধোঁয়ার উৎস। এই মাটির চুলা শুধুই যে এই ঘাগটপাড়ার বাড়িগুলোয় আছে এমন নয়। আবহমানকাল ধরে বাংলাদেশের শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে রান্নার কাজে নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠেছে এই মাটির চুলা। বাংলাদেশে প্রায় ৪১ শতাংশ গৃহস্থালি কাজে এই চুলার ব্যবহার হচ্ছে।
কতটা ভয়াবহ মাটির চুলার ধোঁয়া?
মাটির চুলায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় কাঠ, খড়-কুটো, পাতা, ঘুটে ইত্যাদি।
রান্নাঘরে মাটির যে চুলা ব্যবহৃত হয় সেটিতে প্রাকৃতিক গ্যাস বা কাঠ পোড়ানোর সময় পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাবে তা ভালোভাবে পোড়ে না। ফলে কার্বন মনোক্সাইডের মত বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টি হয়। এটি রান্নাঘরকে ধূমায়িত করে ফেলে মানব স্বাস্হ্যের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে। একইসাথে বায়ুমন্ডলে মিশে গিয়ে বায়ু দূষণেরও সৃষ্টি করছে। নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোতে যারা মাটির চুলায় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে রান্না করে তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যহীনতা এবং মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলো এই চুলা থেকে নির্গত ধোঁয়া। জাতিসংঘ এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে,বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৪৯ হাজার মানুষের অকালে মৃত্যু হয় গৃহস্থালি বায়ু দূষণে, যার প্রধান উৎস মাটির চুলার ধোঁয়া। রান্নার জন্য প্রতিবছর প্রায় ১৫০ কোটি মণ জ্বালানী কাঠ খরচ হয়। বনাঞ্চলের উপর এর প্রভাব পড়ছে।
অভ্যাস বদলানোই চ্যালেন্জ যেখানে
মাফরুহার কথায় ফিরে যাই। রংপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের এই গৃহিণী বছর বছর মাটির চুলায় রান্না করে আসছেন। এই চুলার বিষাক্ত ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্ট আর কাশি নিয়মিত হয়ে যাওয়ায় মাফরুহা এসবে এখন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। তাই প্রথমদিককার মতো পোড়া চোখে এখন আর পানি জমে না। গ্রামীণ জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া এই মানুষগুলো স্বাস্থ্যহানি আর পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতার মধ্যে থেকেও চিরাচরিত এই মাটির চুলাতেই আস্হা রেখে চলেছেন যুগ যুগ ধরে। তবে এই অবস্হার পরিবর্তনও হচ্ছে ধীরে ধীরে।
যদিও সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বায়ু দূষণ রোধে অন্যান্য প্রকল্পের সাথে গৃহস্থালি এই দূষণ রোধে কোনো উদ্যোগের কথা বলা নেই তবু সরকারি ব্যবস্থাপনাতেই উন্নত এবং পরিবেশবান্ধব চুলা তৈরি করে বাজারজাত করা হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। নব্বইয়ের দশক থেকেই বায়ূ দূষণরোধী উন্নত চুলায় গ্রামাঞ্চলের মানুষদের অভ্যস্ত করে তুলতে সরকারের নানা চেষ্টা ছিল। বৃহৎ পরিসরে সেই চেষ্টাগুলো আলোর মুখ দেখে নি। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এক উদ্যোগ মাফরুহাদের মত গ্রামের গৃহিণীদের অভ্যাস বদলাতে অর্থাৎ দূষণ সৃষ্টিকারি মাটির চুলার বিকল্প ভাবনায় আশার আলো দেখাচ্ছে।
ইডকলে আশার আলো
সরকারি প্রতিষ্ঠান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিঃ (ইডকল) পরিবেশবান্ধব ও আধুনিক এক ধরণের চুলা স্থাপনের কার্যক্রম শুরু করে ২০১৩ সালে।
![]() |
ইডকলের উন্নত চুলা। ছবিঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন |
সাধারণ মাটির চুলার তুলনায় এই চুলায় পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পদার্থের উপস্থিতি শতকরা ২০ শতাংশ কম। আর এর ব্যবহারকালে কার্বন শতকরা ৩০ শতাংশ এবং কার্বন মনোঅক্সাইড ৯০ শতাংশ কম উৎপন্ন হয়। আণবিক শক্তি কমিশনের এক পরীক্ষায় এমন তথ্য মিলেছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এই চুলার মূল নকশা করেছে।
বগুড়ায় কর্মরত ইডকলের মাঠপর্যায়ের সহকারী পরিচালক রাসেল আহমেদ বলছিলেন , “এই চুলার বাইরের অংশ কংক্রিটের তৈরি, এর মধ্যে লোহার ছাকনি আছে। এজন্য এতে সাধারণ চুলার চাইতে অক্সিজেনের সরবরাহ বেশি হয়। আর ধোঁয়া বের হওয়ার জন্য এতে তিন ইঞ্চি লম্বা পাইপ ব্যবহার করা হয়েছে। এই পাইপে টুপি থাকায় বৃষ্টির পানি ঢুকে না।” এই চুলার সাধারণ চুলার থেকে ৯০ শতাংশ কম কার্বন মনোক্সাইড নিঃসরণ করে৷
![]() |
বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের প্রতিবেদনে সাধারণ মাটির চুলা ও উন্নত চুলার পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে। ছবিঃ ইডকল। |
৬৬টি সহযোগী সংগঠনের সাথে মিলে ইডকল গ্রামীণ মহিলাদের এই চুলা ব্যবহারে আগ্রহী করে তুলতে জোর প্রচারণা চালিয়েছে। জ্বালানি খরচ কম এবং পরিবেশবান্ধব হওয়ায় গ্রামের মহিলারা এখন এই চুলা স্থাপনে আগ্রহী হচ্ছেন। মাফরুহা বলছিলেন, এটি স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণের যে নূন্যতম খরচটি সেটিও বহন করা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য ছিল। এর প্রেক্ষিতে বেসরকারি কিছু সংস্থা তাদেরকে ঋণ দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। বগুড়ার প্রত্যন্ত গ্রাম সন্ধ্যাবাড়ির গৃহিণী ফাতেমা আক্তারের কথায় জানা গেল এই চুলা ব্যবহারে উপকার পাওয়ার কথা। “মাটির চুলার তুলনায় এই চুলায় কাঠ কম লাগে। আবার রান্নার সময় হাড়িতে কালিও পড়ে না। খাবারও দ্রুত তৈরি হয়।”
![]() |
ধোঁয়ায় চোখে পানি আসার বদলে এখন গৃহিণীদের মুখে হাসি৷ ছবিঃ barcinews |
ইডকলের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ১০ লাখ পরিবারের কাছে এই চুলা পৌঁছে দেওয়া। এই লক্ষ্যমাত্রা দুই বছর আগেই ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে পূরণ করে ফেলে প্রতিষ্ঠানটি। এই সাফল্য আরও বড় স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটিকে। নতুন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে ৫০ লাখ পরিবারের কাছে এই চুলা পৌঁছে দিতে চায় তারা।
বর্তমানে ইডকলের মাধ্যমে দেশের প্রায় ২৯০ টি উপজেলায় এই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে কার্যক্রম চলছে।
গন্তব্য বহু দূর
মাফরুহার মত গ্রামের যেসব মহিলারা এই চুলা ব্যবহার করে উপকৃত হচ্ছেন তারাই এখন সচেতন করছেন, এই চুলার উপকারিতার দিকটি তুলে ধরছেন গ্রামের অন্য মহিলাদের সামনে৷ এভাবে প্রচারণা বাড়ছে, উন্নত চুলা ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠছে গ্রামীণ এলাকার মানুষেরা। একইসাথে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখাতেও ভূমিকা রাখছে এই উদ্যোগ। তবে নানান প্রতিবন্ধকতা আর অভ্যাস বদলের প্রচেষ্ঠায় পুরোপুরি সফলতা আসতে এখনও অনেকটা পথ পাড়ি দেয়া বাকি৷ সরকারও সেই প্রচেষ্টাই অব্যাহত রেখে কাজ করছে।
ট্যাগ : মাটির চুলা, বায়ু দূষণ, গ্রামে বায়ু দূষণ, ইডকল, ইডকলের চুলা, tma, tma bd, air pollution in village, গ্রামে মাটির চুলা, বন্ধু চুলা তৈরির পদ্ধতি,সিমেন্টের তৈরি চুলা,আধুনিক মাটির চুলা,