বনকাগজ: কাগজ থেকে জন্ম নেবে গাছ | Bonkagoj | TmA
Written by : Tanvir Mahatab Abir
চেনা পরিচিত কিংবা আত্মীয়দের বিয়েতে দাওয়াত দিতে নিমন্ত্রণপত্র পাঠানোর চল বেশ পুরোনো। বিয়ের নির্দিষ্ট দিনের পর কাগজের তৈরি এই নিমন্ত্রণপত্রের জায়গা হয় ময়লার ঝুঁড়ি কিংবা ডাস্টবিনে। কিন্তু যদি নিমন্ত্রণপত্র থেকেই জন্ম নেয় গাছ? সেই গাছ থেকেই যদি পাওয়া যায় সবজি কিংবা ফল?
বাংলাদেশের এক তরুণ গবেষক মাহবুব সুমন বনকাগজ নামে এমনই এক অভিনব কাগজ উদ্ভাবন করেছেন। বনকাগজের মধ্যে ৮ রকমের সবজি, সবজি ফল আর তিন রকমের ফুলের বীজ আছে। কাগজগুলো একটু পুরু হওয়ায় সাধারণত আমন্ত্রণপত্র, ভিউকার্ড, ভিজিটিং কার্ড, বাণিজ্যিক পণ্যের প্রাইস ট্যাগ ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা যায়৷ শালবৃক্ষ নামে নিজের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এখন বাণিজ্যিকভাবেই পরিবেশের উপকারী এই কাগজ উৎপাদন করছেন সুমন।
শুরুর গল্প
পড়াশোনা এবং পেশা তড়িৎ প্রকৌশল হলেও মাহবুব সুমনের বরাবরই আগ্রহ পরিবেশ বিষয়ক নানান উদ্ভাবনী উদ্যোগে। এই আগ্রহকে বাস্তব রূপ দিতেই গেল বছরের অক্টোবরে চালু করেন নিজের প্রতিষ্ঠান 'শাল বৃক্ষ '। শুরুতে পরিবেশ-সহায়ক নবায়নযোগ্য শক্তি নিয়ে কাজ করলেও গত ডিসেম্বরে অন্যান্য পণ্যের সাথে বনকাগজের উৎপাদন শুরু করেন সুমন৷ কিভাবে বন কাগজ তৈরির ভাবনা আসলো? সুমন বলছিলেন সে গল্প, "প্রায় এক বছর আগে (২০১৮) যখন আমাদের প্রতিষ্ঠানের (শালবৃক্ষ) ভিজিটিং কার্ড বানানোর কথা চিন্তা করছিলাম, তখন ভাবলাম ব্যতিক্রমী কোনো পথ অবলম্বন করলে কেমন হয়? এদিকে দেশে তখন সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলন চলছে। পরিবেশ তথা সুন্দরবন রক্ষার এই আন্দোলনের কথা চিন্তা করেই মাথায় এলো পরিবেশবান্ধব কিছু করার। ভাবলাম আমরা নিত্য যেসব কাগজ ব্যবহার করছি, তার বেশিরভাগই সাময়িক সময়ের জন্য, অর্থাত্ নির্দিষ্ট একটা সময় পর সেই কাগজগুলো পরিত্যক্ত হিসেবে ফেলে দিচ্ছি ময়লার স্তূপে। যার মধ্যে ভিজিটিং কার্ডও উল্লেখযোগ্য। তাই ভাবলাম, আমাদের ভিজিটিং কার্ড যেন মানুষ নির্দিষ্ট সময় পর ময়লা হিসেবে ফেলে না দিয়ে বরং পরিবেশবান্ধব কাজে লাগাতে পারে। এই চিন্তা-ভাবনা থেকেই এই উদ্যোগ নেওয়া।" সুমনের মতে, এতে একদিকে যেমন ময়লা আবর্জনা থেকে দেশ রক্ষা পাবে, তেমনি অন্যদিকে মানুষ পরিবেশবান্ধব কিছু ফুল এবং শাক-সবজির গাছ পাবে। বিশ্বের কয়েকটি দেশে এই ধরনের কাগজ তৈরি নিয়ে কাজ হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত ১১টি ফসলের বীজ কেউ দিতে পারেনি দাবি সুমনের। "আমরাই প্রথম যারা একসাথে এতোগুলো ফসলের বীজ দিয়ে কাগজটি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি।"
কীভাবে তৈরি হয় বনকাগজ?
পরিবেশ বাঁচানোর ভাবনা থেকেই যেহেতু বনকাগজ তৈরির উদ্যোগ তাই পুরো প্রক্রিয়াটিতেই এর কারিগররা চেষ্টা করেছেন পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা যায় এমন দ্রব্য ব্যবহার করতে। বছর শেষে স্কুলের শিক্ষার্থীদের ব্যবহ্রত অনেক বই খাতাই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। এমন অপ্রয়োজনীয় পরিত্যক্ত কাগজগুলোই সংগ্রহ করেন বনকাগজ তৈরির উদ্যোক্তারা।
মেশিনের মাধ্যমে কাগজগুলো টুকরো করে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয় প্রায় ৪২ ঘন্টা। কাগজগুলো পুরোপুরি গলে গেলে সেগুলো থেকে মণ্ড তৈরি করা হয়। তারপর বসিয়ে দেয়া হয় ফ্রেমের আকারে। বিশেষ প্রক্রিয়ায় এই মণ্ডের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ফুল এবং শাক-সবজির বীজ মিশিয়েই তৈরি করা হয় বন-কাগজ। একদিনে প্রায় ২৫-৩০ টি কাগজ তৈরি করা যায়। বীজগুলো যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য কাজটি করতে হয় খুবই সর্তকতার সাথে। প্রতি পিস কাগজ তৈরিতে বর্তমানে ব্যয় হচ্ছে ১২০-১৪০ টাকা। উৎপাদন বাড়লে এই ব্যয় আরও কমে আসবে বলে আশা সুমনের।
কাগজ থেকে কীভাবে জন্ম নেয় গাছ?
বনকাগজের মধ্যে ৮ ধরনের সবজি আর ৩ ধরনের ফুলের বীজ আছে। এই কাগজ মাটিতে লাগানোর জন্য বিশেষ কোনো নিয়ম নেই। কাগজটি আস্ত অথবা ছিঁড়ে টুকরো করে ফেলে দিলেই ৮ থেকে ১০ দিনের মধ্যে মাটিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা থাকা সাপেক্ষে বীজের অঙ্কেুারোদগম শুরু হয়। মাটি পর্যাপ্ত আর্দ্র না হলে কাগজটিকে মাটির উপর রেখে একটু ভিজিয়ে দিলেই হবে। দশ-বারো দিনের মধ্যে মাটি থেকে বেরিয়ে আসবে শাক-সবজি কিংবা ফুলের চারা গাছ।
আপাতত ঝাল মরিচ, টমেটো (দুই জাত- বড় গোল টমেটো এবং চেরী টমেটো) , লালশাক, বেগুন (গোল-লম্বা দুই জাতেরই),বিলেতি ধনিয়া পাতা, পাটশাক, ডাটাশাক, পেঁয়াজ, কসমস, ডেইজি, মেরিগোল্ড, সূর্যমুখী, মিক্সড পর্তুলিকা, বাটন রোজ, মোরগফুলসহ আরো অল্প কিছু গাছের বীজ ব্যবহার করলেও ভবিষ্যতে আরো বিভিন্ন গাছের বীজ এই প্রকল্পটিতে যুক্ত করবেন বলে জানালেন মাহবুব সুমন। একটি বনকাগজের ভেতরে থাকা বীজ একবছর পর্যন্ত সতেজ থাকে।
বাণিজ্যিকভাবে সফলতা
বাংলাদেশের তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির উদ্যোগে সুন্দরবন ও উপকূলবিনাশী কয়লা বিদ্যুত বন্ধ, গ্যাস রপ্তানিমুখি ‘পিএসসি ২০১৯’ বাতিল এবং সুলভ-টেকসই-পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জাতীয় কমিটির বিকল্প মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নসহ ৫ দফা দাবিতে গত বছরের (২০১৯) ৬ ডিসেম্বর ঢাকায় প্রাণ প্রকৃতি ও মানুষ রক্ষায় জাতীয় কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। সেই অনুষ্ঠানের পরিচয় পত্রটি তৈরি করা হয় মাহবুব সুমনের তৈরিকৃত ‘বনকাগজ’ দিয়ে। এই কনভেশনের পরিচয়পত্র তৈরির মাধ্যমেই বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে গিয়েছে এই বনকাগজ। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত কনভেনশনে রাজনৈতিক নেতা, প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক মিলিয়ে ৪৬০ জনকে বনকাগজে তৈরি কার্ড প্রদান করা হয়। গত মার্চে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে এক প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচার কার্ড তৈরিতে ব্যবহার করা হয় এই বনকাগজ।
ব্যবহারের বিস্তৃতি
মাহবুব সুমন বলছেন, নানান কাজেই বনকাগজের ব্যবহার করা যাবে। আমন্ত্রণপত্র (সেটা বিয়ে হোক কিংবা কোনো সম্মেলনের) থেকে শুরু করে পরিচিতি কার্ড, পণ্যের মূল্যের ট্যাগ, বুকমার্ক এসবের কাজে অনায়াসেই বনকাগজের উপর আস্হা রাখা যাবে। তৈরি করা যাবে ক্যালেন্ডারও। এই কাগজের পরিচিতি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও বিস্তৃতি পেয়েছে। চাহিদার ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি দেশে বন কাগজের তৈরি বেশ কয়েকধরণের কার্ড পাঠানো হয়েছে।
কেমন ছিল এই উদ্যোগ নেয়া থেকে সফল হওয়া পর্যন্ত পুরো পথটা? মাহবুব সুমনের কথায় জানা গেল, খুব একটা সহজ ছিল না কাজটা। "এই কাগজ তৈরি করতে গিয়ে অনেক সময় দিতে হতো। এজন্য উৎসর্গ করতে হয়েছে অনেক কিছু। শেষ পর্যন্ত চাকরিও ছাড়তে হয়। কিন্তু বনকাগজটা আমার কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু বারবার ব্যর্থতা আমাকে আশাহত করে দিয়েছিল। প্রায় ৪-৫ বার প্রচেষ্টার পর কাগজ থেকে গাছ জন্মাতে সক্ষম হই।” সুমন জানালেন, "আমার একার পক্ষে এই কাজটি শেষ করা সম্ভব হতো না। পুরো কাজটিতে আমাকে নানাভাবে সহায়তা করেছে সায়দিয়া গুলরুখ, কামরুল হাসান, ইকরামুনেসা চম্পা। আর তাদের নিয়েই তৈরি ‘শালবৃক্ষ’ টিম। এই দলের সকলের প্রচেষ্টার ফসল আমাদের এই বনকাগজ। "
বাংলাদেশেই প্রথম নয়
কাগজে থাকা বীজ থেকে একের অধিক প্রকারের গাছ তৈরির ধারণাটি সত্তরের দশকে জনসম্মুখে আনেন অষ্ট্রেলিয়ান জীববিজ্ঞানী বিল মলিসন৷ 'পারমাকালচার' নামের এই কৃষিজ পদ্ধতিতে জমিতে কোনো ধরনের রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও আগাছানাশক ব্যবহার করা হয়না। একই জমিতে একসাথে বহু ধরনের ফসলের চাষ হয়। বিশ্বের অনেক দেশেই বহুল ব্যবহ্রত হয়ে আসছে পারমাকালচার। কাগজে থাকা বীজ থেকে গাছ হওয়ার এই পদ্ধতি বাইরের দেশগুলোয় সিডপেপার নামে পরিচিতি পেয়েছে। সারাবিশ্বেই এর তৈরি এবং ব্যবহার পদ্ধতি একইরকম।
তবে বাংলাদেশে তৈরি বনকাগজটির মতো এক কাগজে অধিক সংখ্যক বীজের ব্যবহার অন্যান্য দেশে বিরল। বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোনো ধরণের কীটনাশক কিংবা কৃত্রিম সার ছাড়াই খুব কম সময়ে ফসল ফলানোর এমন পদ্ধতিতে পরোক্ষভাবে উপকৃত হবে পরিবেশই। সুযোগ সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানেরও৷
Tags: bonkogoj, shalbrikkho, mahbub sumon, tma,tmabd, বনকাগজ,মাহবুব সুমনের বনকাগজ,শালবৃক্ষ,কাগজ থেকে গাছ,বন কাগজের গল্প,