ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হয় কীভাবে? | Cyclones in Bay of Bengal

 


Written by : Tanvir Mahatab Abir


প্রতিবছরই বাংলাদেশের উপকূলে এক বা একাধিক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে৷ খেয়াল করলে দেখবেন, সকল ঘূর্ণিঝড়েই স্বতন্ত্র একটি নাম থাকে। এই নামকরণ করা হয় কীভাবে? কারা-ই বা দেয় এই নাম? 


ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ চর্চা বেশ কয়েকশো বছর ধরেই চলছে। প্রত্যেকটি ঘূর্ণিঝড়ের আলাদা আলাদা নাম দেওয়ার পেছনের কারণ হিসেবে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (WMO) বলছে, নামকরণের ফলে ঝড়গুলো দ্রুত শনাক্ত করে সে অনুযায়ী সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহজ হয়। তাছাড়া, সবরকম ব্যবস্থাতেই সংখ্যা অথবা প্রযুক্তিগত শর্তের চেয়ে নাম মনে রাখাটাই সবচেয়ে কার্যকর উপায়। 



প্রাকৃতিক দূর্যোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, কম সময়ে দ্রুত যোগাযোগের ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত ও স্বতন্ত্র প্রদত্ত নামগুলোর ব্যবহার পুরোনো জটিল অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ শনাক্তকরণ পদ্ধতির তুলনায় অনেকাংশেই সুবিধা দেয়। এই সুবিধাগুলো বিশেষত কয়েক শতাধিক বিস্তৃত স্টেশন, উপকূলীয় ঘাঁটি এবং সমুদ্রের জাহাজগুলোর মধ্যে বিশদ ঝড়ের তথ্য বিনিময় করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া, ঝড়ের নামকরণ করার ফলে একই বা কাছাকাছি সময়ে সৃষ্টি হওয়া একের অধিক ঝড়ের তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে ঝামেলা পোহাতে হয় না। তাই সবদিক বিবেচনায় নামকরণের গুরুত্ব রয়েছে। 



শুরুর দিকে অবশ্য ঝড়ের নাম রাখায় কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করা হতো না। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ঝড়ের জন্য নারীসূচক নাম ব্যবহারের অনুশীলন শুরু হয়।


লেখক ইভান রে টানেহিল তার লেখা বই দ্য হারিকেনে অস্ট্রেলিয়ান আবহাওয়াবিদ ক্লিমেন্ট রেগের নাম উল্লেখ করেন, যিনি ঘূর্ণিঝড়ের জন্য প্রথম ব্যক্তিবিশেষের নাম দেয়া শুরু করেছিলেন। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং অ্যান্টার্কটিক অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়ের জন্য তিনি গ্রিক বর্ণমালা, গ্রিক এবং রোমান পৌরাণিক তত্ত্ব ও নারীসূচক নাম ব্যবহার করতেন। 




১৯৭৭ সালে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা হারিকেন কমিটি গঠন করে। এই কমিটির প্রথম বৈঠক হয় ১৯৭৮ সালের মে মাসে। বৈঠকে হারিকেনের পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়েরও নামকরণের দায়িত্ব পায় এই কমিটি।



১৯৭৮ সাল থেকে এই কমিটির সিদ্ধান্তে পূর্ব-উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় ঝড়ের তালিকায় নারীদের পাশাপাশি পুরুষদের নাম ব্যবহার শুরু হয়। পরের বছর মেক্সিকো এবং আটলান্টিক উপসাগরীয় অঞ্চলেও পুরুষদের নাম ব্যবহারের প্রচলন শুরু হতে দেখা যায়। 



বর্তমানে বার্ষিক ও দ্বিবার্ষিক বৈঠকের মাধ্যমে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে বিশ্বব্যাপী পাঁচটি ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় আঞ্চলিক সংস্থা বা প্যানেল কর্তৃক ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের নামের তালিকা নির্ধারণ করা হয়। 



বিশ্ব জুড়ে ঘূর্ণিঝড় নামকরণে দশটি আলাদা অঞ্চলে বিভক্ত রয়েছে:


১. ক্যারিবিয়ান সাগর, মেক্সিকো উপসাগর এবং উত্তর আটলান্টিক


২. পূর্ব-উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর


৩. মধ্য-উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর


৪. পশ্চিম-উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর এবং দক্ষিণ চীন


৫. অস্ট্রেলিয়ান ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় সতর্কতা কেন্দ্রের আওতাভুক্ত


৬. আঞ্চলিক বিশেষায়িত আবহাওয়া কেন্দ্র নাদি'র আওতাভুক্ত, ওয়েলিংটন


৭. মরেসবি বন্দর ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় সতর্কতা কেন্দ্রের আওতাভুক্ত, পাপুয়া নিউগিনি


৮. জাকার্তার ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় সতর্কতা কেন্দ্রের আওতাভুক্ত


৯. উত্তর ভারত মহাসাগরের আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগর


১০. দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত মহাসাগর


ভারতীয় উপমহাদেশ ও এর আশপাশের অঞ্চলগুলোয় সাধারণত ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয় বঙ্গোপসাগর থেকে। এই অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের প্রচলন শুরু হয় ২০০৪ সালে।

২০০৪ সালের নামের তালিকা



ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের জন্য নির্ধারিত পাঁচটি আঞ্চলিক সংস্থা বা প্যানেলের একটি হচ্ছে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা- জাতিসংঘ এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন।


 ২০০০ সালে ওমানে এই প্যানেলের ২৭তম বৈঠকে আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়গুলোর নামকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০০৪ সালে আটটি সদস্য দেশের (বাংলাদেশ, ভারত, মালদ্বীপ, মায়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড) প্যানেলের মাধ্যমে নামকরণ শুরু হয়।



সে সময় আটটি দেশ থেকে ৮টি করে মোট ৬৪টি নামের তালিকা করা হয়। পরবর্তী সময়ে আরও পাঁচটি দেশ এই প্যানেলের সদস্য হয়। এরা হচ্ছে সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান ও ইয়েমেন। 




নামকরণের বিষয়টি সমন্বয় করে ভারতের দিল্লির 'রিজিওনাল স্পেশালাইজড মেটেরিওলজিক্যাল সেন্টার' (আরএসএমসি)। আরএসএমসি তার সদস্য দেশগুলোর কাছ থেকে নামের তালিকা সংগ্রহ করে থাকে। তালিকা পেলে দীর্ঘ সময় যাচাই-বাছাই করে সংক্ষিপ্ত তালিকা করে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার কাছে পাঠানো হয় অনুমোদনের জন্য। এই প্যানেলের নামকরণে বেশ কিছু নিয়ম অনুসরণ করা হয়। প্যানেল সদস্যদের তালিকা হয় ইংরেজি বর্ণমালার ক্রমানুসারে। এজন্য বাংলাদেশ এই তালিকায় প্রথমে আছে। 



প্যানেলভুক্ত প্রত্যেক দেশের সমন্বয়ে তৈরি নামের তালিকা থেকে একটি করে নাম নিয়ে কলাম তৈরি করা হয়। নামকরণ করা শুরু হয় এই কলামে থাকা ওপরের নামটি দিয়ে। এভাবে একটি কলাম শেষ হলে পরের কলাম থেকে নামকরণ করা হয়। একটি নাম শুধুমাত্র একবারই ব্যবহার করা যায়। 


জেনে রাখা ভালো, দক্ষিণ চীন সমুদ্র থেকে যদি কোনো গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় হিসাবে বঙ্গোপসাগরে আসে, তবে আগে থেকে নাম দেয়া থাকলে নতুন করে আর নামকরণ করা হয় না। 


২০০৪ সালে ৬৪টি ঘূর্ণিঝড়ের নামের তালিকা করার পর পরের প্রায় ১৬ বছর এই তালিকা থেকেই নাম দেয়া হয়েছে। তালিকার সর্বশেষে থাকা থাইল্যান্ডের দেওয়া নাম 'আম্ফান' ২০২০ সালের মে মাসের শুরুতে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়ে মায়ানমার ও বাংলাদেশের কক্সবাজার–চট্টগ্রাম উপকূলের দিকে আঘাত হেনেছিল। 

নামের নতুন তালিকা 



তালিকায় নাম শেষ হয়ে যাওয়ায় গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের এপ্রিলে সদস্য ১৩টি দেশ থেকে ১৩টি করে মোট ১৬৯টি নতুন নামের তালিকা করেছে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা। পরবর্তী ঘূর্ণিঝড়গুলোর নাম এই তালিকা থেকেই দেয়া হচ্ছে।  





লেখাটি শেয়ার করে অন্যদের জানতে সাহায্য করুন। ধন্যবাদ৷।