Written by : Tanvir Mahatab Abir
ইউটিউবে একটি অ্যানিমেটেড শর্ট ফিল্ম দেখছিলাম। নাম 'টুমরো'। ভাবছেন, হলিউড কিংবা বাইরের কোনো দেশের তৈরি ফিল্মের কথা বলছি? এমন প্রশ্ন অবশ্য আসাটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে অ্যানিমেশন শর্ট ফিল্ম বানানোটা একরকম বিলাসিতাই ঠেকার কথা। এই ধরনের প্রজেক্টের জন্য দক্ষ নির্মাতা, স্টুডিও কিংবা টিম ওয়ার্কের কথা চিন্তাই করা যায় না। অথচ এক টুমরো'ই বদলে দিয়েছে সব চিন্তাধারা। হঁ্যা, টুমরো বাংলাদেশের তৈরি, বাংলাদেশের নির্মাতাদের তৈরি। বাংলাদেশে এর আগেও অ্যানিমেশন শর্ট ফিল্ম নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু সব ছাপিয়ে টুমরো নিয়েই কেন এত আলোচনা? সেই আলোচনার বিশ্লেষণ করতে চাই এই লেখায়।
২০১৯ সালের নভেম্বরের শেষদিকে দীপ্ত টিভির পর্দায় মুক্তি পায় টুমরো। এরপরই ইউটিউব ও ফেসবুকে আপলোড করা হয় শর্ট ফিল্মটি। বাকি গল্প শুধুই প্রশংসার। দেশে বিদেশে অগণিত মানুষ দেখে চলেছেন ২৫ মিনিটের এই অ্যানিমেশন শর্টফিল্মটি। প্লাটফর্ম হিসেবে শুধু ইউটিউবের ভিউয়ের কথা যদি বলি আপনাদের, এই মুহূর্তে সংখ্যাটা দেখাচ্ছে প্রায় পৌনে ১৮ লাখ। একইসময়ে ফেসবুক ভিউ ৭ লাখ ৮৯ হাজার। দর্শক চাহিদার কথা বিবেচনা করে শর্টফিল্মটি আরো সাতটি ভাষায় ডাবিং করার পরিকল্পনা করেছেন নির্মাতারা। সম্প্রতি ইংরেজি ও হিন্দি/উর্দু ভাষার ডাবিংকৃত ভার্সণ প্রকাশ করা হয়েছে ইউটিউবে। ইংরেজি ভার্সণটি দেখেছেন আড়াই লক্ষাধিক মানুষ। ফেসবুকে দেখেছেন আরো দুই লাখ বেশি মানুষ। উর্দু ভার্সণটি দেখা হয়েছে প্রায় ১০ হাজার বার। ফেসবুকে দেখা হয়েছে সোয়া লাখ বার।
ভিউ দেখে অবশ্য একটি নির্মাণের ভালো-মন্দ বিচার করা যায় না। মানুষ সমালোচনা বা খারাপটা শুনেও দেখতে আসে ভিডিও। আপনাদের জন্য তাই দুইটি মন্তব্য তুলে ধরতে চাই ইউটিউবে টুমরো'র কমেন্টগুলো থেকে।
বাংলাদেশী একজন লিখেছেন, পৃথিবীর যে কোনো অ্যানিমেশনকে টেক্কা দিতে পারবে এই শর্টফিল্মটি। বাংলাদেশের সকল স্কুলের বাচ্চাদের বাধ্যতামূলকভাবে এটি দেখানো উচিত।
ভারত থেকে একজন লিখেছেন, এই ফিল্মটি হলিউডে নির্মাণ হলে এতদিনে অসংখ্য অ্যাওয়ার্ড থাকতো নির্মাতাদের ঝুলিতে। উপমহাদেশে নির্মাণ বলে এখনও এতটা শোরগোল পড়ে নি এটি নিয়ে।
বুঝতেই পারছেন বাংলাদেশের অ্যানিমেশনকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে টুমরো। তবে এটিই যে দেশের প্রথম অ্যানিমেশন প্রোডাকশন, তা কিন্তু নয়। এর আগেও দেশে একাধিক অ্যানিমেশন ফিল্ম নির্মাণ হয়েছে। সম্ভবত ২০০৬ সালে প্রথম অ্যানিমেশন ফিল্ম নির্মাণ দেখেছিল বাংলাদেশের দর্শকরা। 'ত্রাতুলের জগত' নামের ৯০ মিনিটের সেই অ্যানিমেশন ফিল্মটি নির্মাণ করা হয়েছিল কথা সাহিত্যিক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের গল্প অবলম্বনে। একই লেখকের আরেকটি গল্প অবলম্বনে ২০১০/১১ সালে নির্মাণ করা হয় মেকু কাহিনী (২ডি)। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের অ্যানিমেশন নির্মাণশিল্পে পরিবর্তন লক্ষণীয়ভাবেই ধরা পড়ছে। বিজয়, তালপাতার সেপাই'য়ের মতো অ্যানিমেশন ফিল্ম কিংবা শর্টফিল্ম দর্শকদের উপলব্ধি দিচ্ছে বিশ্বমানের নির্মাণের। কিন্তু সব ছাপিয়ে টুমরো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে আলাদাভাবেই। এর পেছনের মূল কারণ সম্ভবত টুমরো'র গল্প।
সর্বমহলে প্রশংসিত টুমরো'র গল্প জলবায়ু পরিবর্তন কেন্দ্রিক। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে জড়িত বিধ্বংসী বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং অন্যান্য পরিবেশ বিপর্যয় বাংলাদেশের প্রায় ১৯ লাখ শিশুর জীবন ও ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে রেখেছে। শিশুদের উন্নতি ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনাকারী জাতিসংঘের বিশেষ সংস্থা ইউনিসেফ এমন তথ্যই জানিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কীভাবে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে এবং তা থেকে উত্তরণ পাওয়ার উপায় নিয়ে আলোচনার ভাবনা থেকে তৈরি হয়েছে স্বল্পদৈর্ঘ্যের অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র 'টুমরো'। কাজী জাহিন হাসান ও কাজী জিসান হাসানের গল্প, ভাবনা ও প্রযোজনায় 'টুমরো' পরিচালনা করেছেন মোহাম্মদ শিহাব উদ্দিন।
ছোট্ট রাতুল এবং বাতাসের বুড়ো এই চলচ্চিত্রটির মূল ভূমিকায় ছিলেন। কক্সবাজারের বাসিন্দা রাতুল জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াল থাবার আশংকা থেকে একসময় শিশুদের নিয়ে এর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান শত্রু জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহার কমাতে তার এই উদ্যোগে টনক নড়ে বাংলাদেশ সরকারের। জীবাশ্ম জ্বালানীর উপর ট্যাক্স বসানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সেই ট্যাক্স থেকে পাওয়া অর্থ ব্যয় হয় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষের কল্যাণে। বহু বছর পর এই দেশের সফলতা অনুকরণীয় হয়ে ওঠে বিশ্বমঞ্চে। এমন করেই এগিয়েছে 'টুমরো'র গল্প।
জলবায়ু পরিবর্তন শুধু বাংলাদেশ নয়, আন্তর্জাতিকভাবেই মহাগুরুত্বপূর্ণ এক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা যেমন ভাবিয়ে তুলছে রাষ্ট্রপ্রধানদের, তেমনি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারে বাড়তে থাকা কার্বন নিঃসরণ চিন্তার ভাঁজ ফেলছে দেশে দেশে। তবু মানুষ অসচেতনভাবে সংকট প্রকট করে তুলছে, গাছ কাটছে নির্বিচারে, বাড়িয়ে তুলছে অক্সিজেন সংকট, বায়ুমন্ডলে ক্রমেই বাড়ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের হার। তাই মানুষকে সচেতন করে তোলাটা সবচেয়ে বড় চ্যালেন্জ। সেই চ্যালেন্জের জায়গায় বড় এক আশা হয়ে এসেছে টুমরো। ইউটিউবের কমেন্টে বেশ কিছু মন্তব্য এসেছে, স্কুলে স্কুলে শিক্ষার্থীদের টুমরো দেখানোর ব্যবস্থা করতে, জনসমাগম হয় এমন স্থান বা পরিবেশেও বড় পর্দায় দেখানোর কথা বলেছেন কেউ কেউ। উদ্দেশ্য একটাই, মানুষকে ভবিষ্যতের ভয়াবহতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করা, সচেতনতার জয়গান ছড়িয়ে দেওয়া। চিন্তা করুন, টুমরো সচেতনতা তৈরির বার্তাটা ঠিকঠাক দিতে পারছে বলেই তো মানুষের এমন মন্তব্য আসছে, তাই না?
টুমরো যে শুধু গল্প দিয়েই দর্শক সাড়া পেয়েছে এমনটা ভাবলে নির্মাতাদের প্রতি অবিচারই করা হবে বোধহয়। নির্মাণযজ্ঞে যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা, সেটির প্রশংসা করতে হয় আলাদাকরে। টুমরো নির্মাণের পথটা বেশ দীর্ঘই বলা যায়৷ ২০১৫ সালে প্রথম ভাবনা আসে এমন নির্মাণের। ব্রিটিশ লেখক চার্লস ডিকেন্স ১৮৪৩ সালে ‘অ্যা ক্রিসমাস ক্যারোল’ নামে একটি উপন্যাস লেখেন। ১৯৭১ সালে এই উপন্যাস নিয়ে অ্যানিমেশন শর্টফিল্ম বানান ব্রিটিশ-কানাডিয়ান অ্যানিমেটর রিচার্ড উইলিয়ামস। মূলত এই ছবিটি দেখেই ‘টুমরো’ বানানোর পরিকল্পনা মাথায় আসে কাজী জিসান হাসানের।
পরের দেড়বছর কেটেছে চিত্রনাট্য লেখার কাজে। স্টোরিবোর্ড ও ক্যারেক্টার ডিজাইনের কাজ শেষে ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকার সাইকোর স্টুডিওতে শুরু হয় 'টুৃমরো'র নির্মাণযজ্ঞ।
শুরুতে পাপেট শো-র মতো করে ডায়ালগ দেওয়া টু-ডি এনিমেশনে এটি তৈরির কথা থাকলেও পরবর্তীতে পরিচালকের ইচ্ছায় থ্রিডি অ্যানিমেশনেই 'টুমরো' তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। ১৫ জনের ছোট একটি দলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় দুই বছরের মাথায় ২০১৯ এর জুলাইয়ে শেষ হয় 'টুমরো' তৈরির কাজ। ২৬ মিনিটের একটি অ্যানিমেশন শর্ট ফিল্ম বানাতে এতটা সময় চলে যাওয়ার পেছনে কারণ ছিল এর গল্পটা ঠিকঠাকভাবে পর্দায় তুলে আনার চ্যালেন্জ। বিশেষ করে শিশুদের বুঝতে পারার মতো উপযোগী করা তোলার জন্য বেশ মনোযোগ দিতে হয়েছে নির্মাণের কারিগরদের। এছাড়া থ্রি-ডি অ্যানিমেশনের বেশ কিছু ধাপ রয়েছে। সেগুলো সম্পন্ন করতে সময় গিয়েছে অনেকটা।
নির্মাতাদের রাতদিনের পরিশ্রমের সফলতা এখন পরিস্কারভাবেই দৃশ্যমান। সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে বাংলাদেশী নির্মাতাদের এই কাজ। টুমরো তাই ছাড়িয়ে গেছে পূর্বের তো বটেই, সমসাময়িক বাংলাদেশী সকল অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রকেই।
নির্মাতারা এখন টুমরো'কে ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছেন বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে। তাই বাংলার পাশাপাশি ডাবিং করা হচ্ছে অন্যান্য ভাষাতেও। 'টুমরো'র এই সাফল্যগাঁথা চলুক। জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানে ছোট্ট এই প্রচেষ্টা ছাপ রাখুক নীতিনির্ধারকদের বড় পদক্ষেপে।