চাঁদে কি জমি কেনা সম্ভব? | Bought land on the moon | TmA

 


চাঁদে কি জমি কেনা সম্ভব? | Bought land on the moon | TmA 


Written by : Tanvir Mahatab Abir



"বিবাহবার্ষিকীতে স্ত্রীকে চাঁদের জমি উপহার’" - এমন শিরোনামের একটি খবর গেল কয়েকদিনে ছড়িয়েছে বাংলাদেশের মিডিয়ায়। খবরে বলা হচ্ছে, খুলনা নগরের মডার্ন মোড় এলাকায় বসবাসকারী অসীম নামের এক ব্যক্তি দাবি করেছেন, তিনি তাঁর ষষ্ঠ বিবাহবার্ষিকীতে স্ত্রী ইসরাত টুম্পাকে চাঁদের জমি কিনে দিয়েছেন। 


কীভাবে কিনলেন চাঁদের জমি এমন প্রশ্নে তিনি জানিয়েছেন, এই কেনাকাটা সেরেছেন মার্কিন নাগরিক ডেনিস হোপের ওয়েবসাইট সী ডটকম থেকে। দাম পড়েছে ৪৫ ডলার। এবং তিনি অনুপ্রেরণা পেয়েছেন ভারতের এক ব্যক্তির কাছ থেকে। ওই ভারতীয় ব্যক্তিও বিবাহবার্ষিকীতে তাঁর স্ত্রীকে চাঁদের জমি উপহার দিয়েছিলেন।



ডেনিস হোপের লুনার এম্বেসীতে চাঁদে জমি কেনার জন্য আবেদন করেন অসীম। ২০ সেপ্টেম্বর জমির কাগজ ই–মেইলের মাধ্যমে তাঁকে পাঠানো হয়। জমি কেনার পর তাঁকে একটি বিক্রয় চুক্তিনামা, কেনা জমির একটি স্যাটেলাইট ছবি, জমিটির ভৌগোলিক অবস্থান এবং মৌজা-পর্চার মতো আইনি নথিও পাঠিয়েছে লুনার এমবাসি।


এর আগের সপ্তাহেও বাংলাদেশের আরো দুই তরুণের চাঁদে জমি কেনার খবর বেরিয়েছিল। সে খবরে বলা হয়, চাঁদের জমি বিক্রি করা মার্কিন নাগরিক ডেনিস হোপের ‘লুনার এম্বেসী’ থেকে এক একর জমি কিনেছেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পাতাখালি গ্রামের দুই বন্ধু এস এম শাহিন আলম ও শেখ শাকিল হোসেন। মাত্র ৫৫ ডলার দিয়ে জমি কেনার দাবি তাদের। ১৫ সেপ্টেম্বর সেই জমির দলিলও পেয়েছেন। চাঁদের ম্যাপেও উল্লেখ রয়েছে কোথায় তাদের জমি।  

জমির দলিল




চাঁদের মালিকানা নিয়ে ইতিহাসে কী আছে? 


১৯৬৯ সালে নিল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিন চাঁদের বুকে অবতরণ করেন। চাঁদের বুকে সেবারই প্রথম মানুষের পদচিহ্ন পড়েছিল। তারপর ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আরও কয়েকটি অভিযানে মানুষ চাঁদের বুকে অবতরণ করেছিল। কিন্তু ১৯৭২ সালের পর থেকে আর কোনো মানুষ চাঁদে অবতরণ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা যখন চাঁদের বুকে প্রথম মনুষ্যবাহী যান পাঠানোর পরিকল্পনা করছিল, তখন জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য ‘আউটার স্পেস ট্রিটি’ নামের এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।ওই চুক্তিতে বলা হয়, কোনো নির্দিষ্ট দেশ চাঁদসহ মহাকাশের অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহের সার্বভৌমত্ব বা মালিকানা দাবি কিংবা কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ১১১টি দেশ এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।কিন্তু ১৯৬৭ সালের চুক্তিতে চাঁদের ভূমির ওপর ব্যক্তিগত ও করপোরেট অধিকার নিয়ে কিছু বলা হয়নি। ফলে আসলেই যদি ধনী কোনো ব্যক্তি চাঁদের বুকে একখণ্ড জমি কিনতে চায়, তার বেলায় কী হবে, সেটি অস্পষ্ট থেকে যায়।


আরো পড়তে পারেন- দাবানলের ধোঁয়া সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে!


 ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে ‘মুন অ্যাগ্রিমেন্ট’ নামে আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে বলা হয়, পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহটিকে শুধু বিশ্ববাসীর শান্তির স্বার্থে ব্যবহার করা যাবে এবং চাঁদে যদি কেউ কোনো স্টেশন স্থাপন করতে চায়, তাহলেও জাতিসংঘকে আগে জানাতে হবে।


মুন অ্যাগ্রিমেন্টে বলা হয়, ‘চাঁদ এবং এর প্রাকৃতিক সম্পদের সাধারণ উত্তরাধিকার সমগ্র মানবজাতি’ এবং কেউ যদি এসব সম্পদের অপব্যবহার করে, তাহলে তা প্রতিহত করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক শাসনব্যবস্থা তৈরি করা হবে। মুন অ্যাগ্রিমেন্টে যেহেতু চাঁদের উত্তরাধিকার হিসেবে ‘সমগ্র মানবজাতির’ কথা বলা হয়েছে, তাই অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে চাঁদে ব্যক্তিগত ও করপোরেট মালিকানা নিষিদ্ধ।



কিন্তু এই চুক্তির দুর্বলতা হচ্ছে, মাত্র ১১টি দেশ এতে স্বাক্ষর করেছে। স্বাক্ষরকারী দেশের তালিকায় আছে ফ্রান্স এবং ভারত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও চীনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো এই চুক্তিকে অনুমোদন দেয়নি।২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ‘কমার্শিয়াল স্পেস লঞ্চ কমপিটিটিভনেস অ্যাক্ট’ নামের এক আইন পাস করে। যার ফলে মার্কিন নাগরিকেরা মহাকাশের এমন যেকোনো কিছুর মালিকানা নিতে পারবে, যেখানে তারা পানি এবং অন্যান্য খনিজ সম্পদের জন্য খননকার্য পরিচালনা করতে পারবে। এই আইনের কারণে মার্কিন নাগরিকেরা মূলত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে মহাকাশকে ব্যবহারের অনুমতি পায়। যদিও চাঁদকে এই আইনের বাইরে রাখা হয়েছে। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে চাঁদও যে এমন কোনো আইনের অন্তর্ভুক্ত হবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।২০১৭ সালে লুক্সেমবার্গও একই রকম একটি আইন প্রণয়ন করেছে। যেখানে সে দেশের নাগরিকদের মহাকাশে থাকা সম্পদের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠার সুযোগ রাখা হয়েছে।



তাহলে কী চাঁদে জমি কেনার ব্যাপারটি ভাঁওতাবাজি?  



চাঁদে জমি কেনার জন্য মার্কিন নাগরিক ডেনিস হোপের ‘লুনার এম্বেসী’-ই হলো সবচেয়ে জনপ্রিয় কোম্পানি। তাদের তথ্যানুযায়ী, চাঁদে জমির দাম একর প্রতি ২৪.৯৯ ডলার থেকে সর্বোচ্চ ৪৯৯ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ২ হাজার ১২৫ টাকা থেকে ৪২ হাজার ৪৩৭ টাকা।


কিন্তু জাতিসংঘের ‘আউটার স্পেস ট্রিটি’ চুক্তি অনুযায়ী, চাঁদে কেউ জমি কিনতে পারে না। তবে কিছু দেশের নাগরিক আইন বা চুক্তির ফাঁকফোকর বের করে চাঁদ এবং অন্যান্য গ্রহ–উপগ্রহে জমি বিক্রির নাম করে পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে। যাঁরা কিনছেন, তাঁরা আসলে প্যাকেটভর্তি বাতাসই কিনছেন!


ডেনিস হোপ কি তাহলে প্রতারণা করছেন? 


ডেনিস হোপ হলো একজন মার্কিন নাগরিক। ১৯৮০ সাল থেকে তিনি চাঁদে জমি বিক্রি শুরু করেছেন। ডেনিস হোপের চাঁদে জমি বিক্রি করার সংস্থাটির নাম হলো ‘লুনার এম্বেসী‘। এই সংস্থাটির মাধ্যমেই ডেনিস হোপ এর কাছ থেকে সবাই চাঁদের জমি ক্রয় করে। 


যদিও চাঁদের জমি বলে কথা তবুও দাম রয়েছে সাধ্যের মাঝেই। এক একর জমির দাম ধরা হয়েছে ২৪.৯৯ ডলার। ৫ একর জমি ১২৪.৯৫ ডলার, ৮ একর জমি ১৯৯.৯২ ডলার, ১০ একর ২৪৯.৯০ ডলার, ১৫ একর ৩৭৪.৮৫ ডলার এবং ২০ একর ৪৯৯.৮০ ডলারে কেনার সুযোগ রাখা হয়েছে। শুধু চাঁদেই নয়, একই দামি শুক্র, বুধ, মঙ্গল এবং বৃহস্পতি গ্রহের সমপরিমাণ জমি পাওয়া যাবে এই ওয়েবসাইট থেকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আপনি চাইলে পুরো প্লটো গ্রহ একাই কিনতে পারবেন। এর জন্য আপনাকে খরচ করতে হবে আড়াই লক্ষ ডলার। 

চাঁদে জমির দাম 



 ডেনিস হোপ এর মতে, চাঁদে এসব জমির মালিকানা নাকি আইনত বৈধ। আবার এসব জমির আইনি নথি, দলিল,মোজা পরচাও রয়েছে।



১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য ‘আউটার স্পেস ট্রিটি’ চুক্তিটির কথা আপনাদের একটু আগেই জানিয়েছিলাম। চুক্তিতে চাঁদের ভূমির ওপর ব্যক্তিগত ও করপোরেট অধিকার নিয়ে কিছু বলা হয়নি। ফলে আসলেই যদি ধনী কোনো ব্যক্তি চাঁদের বুকে একখণ্ড জমি কিনতে চায়, তার বেলায় কী হবে, সেটি অস্পষ্ট থেকে যায়।


ডেনিস হোপ


ডেনিস হোপ ঠিক এই ব্যাপারটিরই ফায়দা নিয়েছেন। তিনি ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চাঁদসহ সৌরজগতের আটটি গ্রহ (পৃথিবী ব্যতিত) ও তাদের উপগ্রহের মালিকানা দাবি করে চিঠি পাঠান। দাবিটি গ্রহণ এবং নিবন্ধন করার পর ডেনিস হোপ রাশিয়ান ফেডারেশন এবংং জাতিসংঘকে একটি চিঠি পাঠান যেখানে তিনি নিজেকে চাঁদ এবং এর খনিজ সম্পদের মালিকানা দাবি করেন। সেই চিঠির জবাব অবশ্য দেয় নি সংস্থাটি। এই জবাব না দেওয়াকে সম্মতির লক্ষণ ভেবে নিয়ে ডেনিস হোপ চাঁদের জমি বিক্রি করা শুরু করেন। এ পর্যন্ত হোপ তার ওয়েবসাইটের মাধ্যমে চাঁদ, শুক্র গ্রহ, বুধ গ্রহ, মঙ্গল গ্রহ এবং বৃহস্পতি গ্রহের প্রায় ৬১১ মিলিয়ন একর জমি বিক্রি করেছেন। 


হোপ বলছেন, জমি কেনার তালিকায় আছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ, জিমি কার্টার, রোনাল্ড রিগ্যানসহ ৬৭৫ জন সেলিব্রেটি। 



ডেনিস হোপের দাবি যদি জাতিসংঘ মেনেও নেয় তাহলে চাঁদের উপর কর্তৃত্ব বা মালিকানা কিন্তু পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষেরই আছে। প্রত্যেকটা মানুষই নিজেকে চাঁদের মালিক দাবি করতে পারবে। কারণ ডেনিস হোপের আইনের মারপ্যাঁচ মতে কোনো রাষ্ট্র মালিকানা দাবি করতে না পারলেও যেকোনো ব্যক্তি মালিকানা নিজের বলে দাবি করতে পারবে।


তাহলে এবার চিন্তা করুন, যে জমির মালিকানা আপনারই আছে, সেটি আপনি আবার টাকা দিয়ে কিনতে যাবেন কেন! 


তথ্য সূত্র : বিবিসি বাংলা, লুনার এম্বেসী, জাতিসংঘ, সায়েন্স বী, প্রথম আলো। 


Tags: চাঁদে জমি, চাঁদে জমি কেনা সম্ভব, চাঁদে জমি বিক্রি,চাঁদে কি আসলেই জমি কেনা যায়,Bought land on the moon,tma, tmabd, ডেনিস হোপ, লুনার এম্বেসী, চাঁদে জমি কেনার নিয়ম,