দাবানলের ধোঁয়া সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে! | Wildfire Smoke Raises Infectious Disease Risk | TmA

 


দাবানলের ধোঁয়া সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে! | Wildfire Smoke Raises Infectious Disease Risk | TmA 


Written by : Tanvir Mahatab Abir


বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসে ইতোমধ্যেই লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এই মৃত্যুর মিছিলের আঁচ আমেরিকানদের গায়েও লেগেছে। তবে এর সাথে গেল পর পর দুই গ্রীষ্মে পশ্চিম আমেরিকানরা ভয়াবহ দাবানলও দেখেছে। শুধু এই বছরই প্রায় সাড়ে ৪৩ হাজার দাবানলের ঘটনায় ৫ মিলিয়ন একরেরও বেশি জমি পুড়ে গেছে। দিনে দিনে দাবানলের পরিমাণ যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে এর তীব্রতাও। এর ফলে দাবানল থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া বায়ু দূষণের কারণ হয়ে উঠছে। এই দূষণ মানব স্বাস্থ্যের সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 


দাবানলের ধোঁয়া কতটা ভয়াবহ?  


বায়ু দূষণের কারণে মানব স্বাস্থ্য যে ভয়াবহ ঝুঁকিতে আছে এটা বহুদিন ধরেই বলে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। গবেষণায় এসেছে, প্রতিবছর গড়ে ৯ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটে বায়ু দূষণ সৃষ্ট রোগে। বিজ্ঞানীরা দাবানল থেকে সৃষ্ট ধোঁয়ার কারণে মানব স্বাস্থ্যে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হয় সেটি নিয়েও বেশ অনেকদিন ধরেই গবেষণা করছেন। সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দাবানল থেকে সৃষ্ট বায়ু দূষণে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ৩৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। কয়েক দশক ধরেই বিজ্ঞানীরা অ্যাজমা, ডায়াবেটিস, অ্যালার্জি কিংবা ক্যান্সারের মতো রোগগুলোয় বায়ু দূষণ থেকে আসা বিষাক্ত কণার যোগসূত্র খুঁজে পাওয়ার কথা বলে আসছেন। 


যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানায় করা এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ঘন ঘন দাবানল থেকে সৃষ্ট ধোঁয়ার সাথে পরের শীত মৌসুমে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার সাথে সম্পর্ক রয়েছে৷ ইনফ্লুয়েঞ্জার অস্বাভাবিক ভয়াবহতা সাধারণত এই অঞ্চলে দেখা যায় না। এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন মন্টানা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটেশনাল ইকোলজিস্ট ইরিন ল্যান্ডগুথ। তিনি আশা করেছিলেন ফ্লু এর মৌসুম শুরুর আগে দাবানলের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ার সময় থেকেই ফ্লু ধরনের স্বাস্থ্যগত জটিলতা দেখা দিয়েছিল বেশ স্থানীয়দের মধ্যে। তার আশা যে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে গবেষণার আগ পর্যন্ত তিনি সেটা ভাবেন নি। দেখা গেছে, দাবানলের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ার সময়টায় বাতাসে ২.৫ বস্তুকণার মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল আশঙ্কাজনক হারে। বাতাসে সে সময় বাড়তি থাকা ২.৫ বস্তুকণা প্রভাব ফেলেছে পরের শুষ্ক অর্থাৎ শীত মৌসুমে। গবেষণা বলছে, সে সময় অন্যান্য বারের তুলনায় ১৬ থেকে ২২ শতাংশ পর্যন্ত ফ্লু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। এই ফলাফল চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে গবেষকদের কপালে। তারা মনে করছেন, বাতাসে বিষাক্ত বস্তুকণা ছড়িয়ে পড়ার যে কারণগুলো রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বিপদজনক দাবানলের ধোঁয়া৷ 


দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার উপর করা সাম্প্রতিক আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, দাবানলের ধোঁয়া থেকে সৃষ্ট ২.৫ বস্তুকণা হাসপাতালে ফ্লু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অন্য সময়ের তুলনায় ১০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে। একই গবেষণায় এই ধোঁয়াকে বায়ু দূষণের অন্য উৎসগুলোর তুলনায় ১০ গুণ বেশি ক্ষতিকারক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।  




কেন এত ভয়ংকর দাবানলের ধোঁয়া?  


দাবানলের ধোঁয়ায় যে ২.৫ বস্তুকণাগুলো দেখা যায় তা ভিন্ন ভিন্ন উৎস থেকে আসে। দাবানল বনের গাছ যেমন পোড়াচ্ছে একইভাবে রাবার, ধাতু, প্লাস্টিক কিংবা গ্লাসের মতো উপাদানও পোড়াচ্ছে। ফলে একাধিক উৎস থেকে বস্তুকণা মিশছে দাবানলের ধোঁয়ায়, হয়ে উঠছে বিষাক্ত। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সাধারণ বায়ু দূষণে থাকা ২.৫ বস্তুকণার তুলনায় দাবানলের ধোঁয়ায় থাকা ২.৫ বস্তুকণার পরিমাণ প্রায় চার গুণ বেশি। 


 ২০১৭ সালের ৫০ দিন মন্টানার ওয়েস্ট ব্লান্কেট সিলিলেকে গড়ে প্রতিদিনের বায়ুমান ছিল ২২১ মাইক্রোগ্রাম। সাধারণত এই মান ১৫০ মাইক্রোগ্রামের উপরে গেলেই অস্বাস্থ্যকর বলে ধরা হয়। সে সময় দাবানলের ধোঁয়া থেকে এলাকাটিতে ২.৫ বস্তুকণার আধিক্য ঘটে। ফলে দূষণও বেড়ে যায়। মন্টানা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এলাকাটির ৯৫ জন বাসিন্দার উপর পরের দুই বছর ধরে গবেষণা চালান। দাবানলের সময়টায় সেই মানুষগুলোর মধ্যে ১০ শতাংশের ফুসফুসে অ্যাজমার মতো উপসর্গ দেখা দিয়েছিল। এর ঠিক এক বছর পর এই সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৪৬ শতাংশে! দাবানলের ধোঁয়া ঠিক কতটা ঝুঁকিতে ফেলছে মানব স্বাস্থ্যকে, তা এই গবেষণা থেকেই স্পষ্ট।  


করোনা পরিস্থিতিকেও ঝুঁকিতে ফেলছে দাবানলের ধোঁয়া 


করোনা ভাইরাস ফুসফুসকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলতে সক্ষম। সেই সক্ষমতায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে দাবানলের ধোঁয়ার বিষাক্ততা৷ গেল বছর করোনার ভয়াবহতার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে দাবানলের ঘটনা ঘটে। দেশটির ক্যালিফোর্নিয়া, ওরেগন এবং ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের ৯২টি কাউন্টিতে দাবানলের ঘটনায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক গবেষণা শুরু করেন। তারা দেখতে চেয়েছিলেন, করোনার ঝুঁকিতে কতটা প্রভাব রাখছে দাবানলের ধোঁয়া। হার্ভাডের জৈব-পরিসংখ্যানবিদ ফ্রান্সিকা ডমিনিকি ছিলেন সেই দলে। তিনি বলছেন, দাবানল মহামারীকে আরো ভয়ংকর করে তুলেছে। তাদের গবেষণা বলছে, যদি দাবানলের ধোঁয়া না থাকতো তাহলে ১৯,৭৪২ জন কম আক্রান্ত হতেন এই ভাইরাসে। একইভাবে ৭৪৮ জন রেহাই পেতে পারতেন মৃত্যুর মিছিল থেকে। অঙ্গরাজ্যগুলোয় ১১শতাংশ বেশি করোনা রোগ শনাক্ত ও ৮ শতাংশ বেশি মৃত্যুর জন্য দায়ী দাবানলের ধোঁয়া থেকে সৃষ্ট বিষাক্ত ২.৫ বস্তুকণা।




 ডমিনিকি স্বীকার করছেন, তিনি এবং তার দল যে ফলাফল পেয়েছেন সেটি একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে থাকা তথ্যের বিশ্লেষণ মাত্র। কিন্তু ২.৫ বস্তুকণা শত শত মাইল পাড়ি দিতে সক্ষম, তাই এর ভয়াবহতা কিংবা প্রভাব ঠিক কতটা ছড়ায় তা নিয়ে ব্যাপক পরিসরে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। 



দুইয়ের সাথে লড়াই 


করোনায় ইতোমধ্যেই দেশে দেশে মৃত্যুর তালিকা বেশ দীর্ঘ হয়ে উঠেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও ভয়ংকর করে তুলছে করোনা আক্রান্তদের বেঁচে থাকাটা। বায়ু দূষণের কারণে শ্বাসকষ্ট কিংবা অ্যাজমার মতো রোগগুলো গেল কয়েক দশকে যেমন বেড়েছে তেমনি মহামারী এসে এই রোগগুলোর ছড়িয়ে পড়াটা ত্বরান্বিত করে তুলেছে বহুগুণে। দাবানলের ঘটনা ঘটে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই। তাই মহামারী ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো প্রকৃতির দুই দুর্যোগের সাথে লড়াই করতে হচ্ছে মানুষকে। দুই দুর্যোগ এক হয়ে সংক্রমণের ভয়াবহতা বাড়াচ্ছে বিভিন্ন দেশেই। করোনার সাথে একটা সময় অভ্যস্ত হতে শিখে যাবে মানুষ। নিউ নরমাল জীবনে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় চিন্তার কারণ হয়ে উঠতে পারে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এর সাথে একীভূত হওয়াটা। বিজ্ঞানীরা তাই এখনই রাষ্ট্রগুলোকে দাবানলের মতো ঘটনা মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ নিতে বলছেন। 



Tags: wildfire, infectious diseases, দাবানলের ধোঁয়া, সংক্রামক রোগের ঝুঁকি, ধোঁয়া থেকে সংক্রামক রোগ, tma, tmabd, ছড়িয়ে পড়ছে দাবানলের ধোঁয়া, দাবানল ও করোনা,