ইভ্যালির বিজনেস মডেল | Business Model of Evaly | TmA

 


ইভ্যালির বিজনেস মডেল | Business Model of Evaly | TmA 


লেখা : নাজিম উদ্দিন শেখ 


করতেন বাচ্চাদের ডায়পার বিক্রির ব্যবসা, হুট করে মাথায় আসে ই-কমার্স ব্যবসার। লেগে পড়েন তাতে। শুরু হয় ইভ্যালির পথচলা। এরপর মোহাম্মদ রাসেলের পরিচিতি বাড়তে থাকে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে একের পর এক লোভনীয় অফার দিয়ে গ্রাহক টানে দেশীয় এই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। বিশাল অফার, ছাড়ের ছড়াছড়ি আর ক্যাশব্যাকের আকর্ষণ দিয়ে ক্রেতা বাড়ানোর কৌশল নিয়ে সফল হলেও প্রতিষ্ঠানটি এখন গ্রাহক ভোগান্তির শীর্ষে। এই লেখায় প্রতিষ্ঠানটির বিজনেস মডেল নিয়ে আলোচনা করতে চাই। 

 


নিজেদের অপারেশনাল স্ট্র্যাটেজি "লিন অপারেশন ম্যাথড" ফলো করে এসেছে ইভ্যালি। অর্থাৎ প্রতিনিয়ত কাস্টমার ও অর্ডার এর সংখ্যা বাড়লেও নিজেদের রিসোর্স সীমিত রেখেছিল কোম্পানিটি। 


শুরু থেকেই মার্কেটিং ও এডভার্টাইজিং এ অনেক খরচ করলেও ইভ্যালির গ্রোথ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে ওয়ার্ড অফ মাউথ মার্কেটিং। মূলত তাদের বিশাল ছাড়,ক্যাশ ব্যাক সহ লাগাতার ক্যাম্পেইন গুলোর কারণে ইভ্যালি ওয়ার্ড অফ মাউথ মার্কেটিং এর সুবিধা বেশ ভালো ভাবেই কাজে লাগাতে পেরেছে । যদিও ডেলিভারি পেতে দেরি হওয়া সহ আরও বিভিন্ন ধরনের অভিযোগের কারণে ইভ্যালি কে ঘিরে তৈরি হয়েছে সমালোচনাও। 


ইভ্যালির পণ্য ডেলিভারি মডেল


 পণ্য ডেলিভারির ক্ষেত্রে ইভ্যালি অনেকটাই আমাজন এর মডেল ফলো করে। 


এক্ষেত্রে অর্ডার পাওয়ার পর সেলারের কাছ থেকে পণ্য প্রথমে ইভ্যালির ওয়ার হাউজে আসে। এরপর ওয়ার হাউজে থেকে পণ্য এক্সপ্রেস বুথে পৌঁছে দেয়া হয় এবং সেখান থেকে রাইড শেয়ারিং মডেল ফলো করে সব থেকে কাছাকাছি থাকা ইভ্যালির ভেরিফাইড ডেলিভারি হিরোরা কাস্টমারের কাছে পণ্যটি পৌঁছে দেয়।



ইনসেন্টিভ মডেল


আদতে লাভ করতে না পারলেও ইভ্যালির নেট লসের পরিমান এত বেশি পরিমানে হচ্ছে না। ই-কমার্স ব্যবসায় শুরু থেকেই লাভ করতে হবে এমন পরিকল্পনা কারোরই থাকে না। বরং ইন্টারন্যাশনাল সব বড় বড় জায়ান্টরাও শুরু থেকে বেশ কয়েক বছর লসের মাধ্যমে ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত করেছে৷ ই-কমার্সের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হচ্ছে ক্যাশ ফ্লো ঠিক রেখে কাস্টমারের সংখ্যা বাড়িয়ে যাওয়া। ইভ্যালির সিইও মোঃ রাসেলও বিভিন্ন সময়ে এমন কথাই বলেছেন।




প্রতিষ্ঠানটির বিজনেস মডেল পর্যালোচনা করলে এ বিষয়ে স্পষ্ট একটি ধারনা করা সম্ভব হবে। ইভ্যালির বিজনেস মডেল পর্যালোচনা করলে শুরুতে যে বিষয়টি আসবে সেটি হলো ইনসেন্টিভ মডেল। 


শুরু থেকেই ইভ্যালি বিভিন্ন ছাড়, ক্যাশ ব্যাক ক্যাম্পেইন, ভাউচার অফার, গিফট কার্ড সহ নানা ধরনের ইনসেন্টিভ প্রদান করে কাস্টমারদের আকৃষ্ট করত। মূল দামের চেয়ে ডিস্কাউন্ট এর মাধ্যমে এভাবে পণ্য বিক্রি করতে অনেক বেশি আগ্রহী ছিল তারা। ইভ্যালির ইনসেন্টিভ মডেলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যাপার হচ্ছে এর ক্যাশব্যাক অফার৷ 


ইভ্যালি থেকে পণ্য কিনলে ক্ষেত্রবিশেষে ১০% থেকে শুরু করে ৩০০% পর্যন্ত ক্যাশব্যাক পাওয়া যায়৷ ক্যাশব্যাক পেতে সাধারনত পণ্য অর্ডার করে পেমেন্ট করে পণ্য কনফার্ম করলেই ক্যাশব্যাকের টাকা কাস্টমারের ইভ্যালি ব্যালেন্সে জমা হয়। এই ব্যালেন্স দিয়ে পরবর্তীতে ইভ্যালি থেকেই অন্য পণ্য কেনা যায়। 


ইনসেন্টিভ মডেলের উদাহরণ 


ইনসেন্টিভ মডেলের উদাহরণ বুঝতে হলে আপনাদের কিছুটা মাথা খাটানোর প্রয়োজন পড়বে। ধরা যাক, ১০০ টাকা মূল্যের একটি পণ্যে ১০০% ক্যাশব্যাক রয়েছে। অর্থাৎ পণ্যটি কিনলে ক্যাশব্যাক অফার হিসেবে ১০০ টাকা কাস্টমারের ইভ্যালি ব্যালেন্সে যোগ হবে। 


ধরি, জনাব শরীফ ইভ্যালির একজন কাস্টমার৷ তিনি ইভ্যালিতে ১০% ক্যাশব্যাকে ১০০ টাকার একটি পণ্য কিনলেন। প্রথম পণ্যটিতে ইভ্যালির লাভ ছিল ১০% বা, ১০০ টাকায় ১০ টাকা। তাহলে ইভ্যালির খরচ ছিল ৯০ টাকা। ক্যাশব্যাক পাওয়ার পর শরীফের ইভ্যালি ব্যালেন্সে থাকলো ১০০ টাকা। 


এখন, ক্যাশব্যাকের ব্যালেন্স শেষ করতে জনাব শরীফ আবারো ইভ্যালি থেকে আরেকটি পণ্য কিনতে আগ্রহী হবেন। তবে ইভ্যালির নিয়ম অনুযায়ী, নতুন অর্ডারে ৬০% এর বেশি ইভ্যালি ব্যালেন্স থেকে খরচ করা যাবেনা। অর্থাৎ নতুন অর্ডারে জনাব শরীফ ক্যাশব্যাকের ব্যালেন্স থেকে ৬০% বা ৬০ টাকা খরচ করবেন। বাকী ৪০% বা ১০০ টাকায় ৪০ টাকা নতুন করে ইভ্যালিতে বিনিয়োগ করতে হবে।


নতুন পণ্যটিতেও যদি ইভ্যালি ১০% লাভ রাখে তাহলে ২ টি পণ্য থেকে ইভ্যালির মোট খরচ হবে ৯০+৯০=১৮০ টাকা। অপরদিকে, ইভ্যালি জনাব শরীফের কাছ থেকে ব্যালেন্স সংগ্রহ করেছিল ১০০+৪০=১৪০ টাকা। সে হিসেবে, ইভ্যালির নেট লসের পরিমান দাঁড়ায় ১৮০-১৪০=৪০ টাকা, অর্থাৎ মাত্র ২২%। 




কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে এমন লস মনে হলেও বিষয়টি কিন্তু তা নয়৷ প্রকৃত পক্ষে, তখনো কাস্টমারের ইভ্যালি ব্যালেন্সে আরো ৪০ টাকা থেকে যায়। এটি খরচ করতে আবারো কাস্টমার ইভ্যালি থেকে নতুন পণ্য কেনেন এবং প্রতিবারে ৪০% করে নতুন ইনভেস্ট করেন। এভাবে দ্বিতীয়বার লাভ করতে না পারলে, তৃতীয় কিংবা চতুর্থবার কেনাকাটার ক্ষেত্রে ইভ্যালি লাভের মুখ দেখতে পারে৷ 


ইভ্যালি মূলত কাস্টমারদের মন – মানসিকতায় ক্যাশব্যাক ব্যবহার করে পণ্য কেনার মানসিকতাকে জাগিয়ে দেয়৷ ক্যাশব্যাকে কাস্টমারেরা এ পরিমানে অভ্যস্ত হয়ে যায় যে, তারা নগদ টাকায় কেনাকাটা করলে যে পরিমাণে চিন্তা ভাবনা করত, ক্যাশব্যাকের ক্ষেত্রে সেই সেল্ফ কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলে। ফলে ইভ্যালির অর্ডারের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে তাদের প্রফিটের পরিমানও। 


তাছাড়া অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে দেখা যায় ইভ্যালির লাভের পরিমাণ ১০% এর চেয়ে অনেক বেশি থাকে। ‘হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ’ এর একটি আর্টিকেল অনুযায়ী, নতুন কাস্টমারকে আকৃষ্ট করতে পুরনো কাস্টমার ধরে রাখার খরচের তুলনায় ২৫ গুণ পর্যন্ত বেশি টাকা খরচ হতে পারে৷ অন্যদিকে, কাস্টমার ধরে রাখার ক্ষেত্রে, মাত্র ৫% ধরে রাখতে পারলেও ব্যবসায় লাভের পরিমাণ ২০ থেকে ২৫% পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। ইভ্যালির ক্যাশব্যাক ইন্টেন্সিভ মডেল প্রতিষ্ঠানটির কাস্টমার ধরে রাখার হার বাড়াতে অনেক সাহায্য করেছে৷ 


Group Buying বা বাঞ্জি স্কিম মডেল


ইভ্যালি তার বিজনেসে মডেলে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে তা কিন্তু নয়৷ ইভ্যালির সিইও মোঃ রাসেল মূলত চায়নার কিছু বিখ্যাত ই-কমার্স মডেলকে ফলো করেছেন। এগুলোর মধ্যে একটি জনপ্রিয় স্ট্র‍্যাটেজি হচ্ছে Group Buying বা দলবদ্ধভাবে কেনা। এই স্ট্র‍্যাটেজিতে, অনেক বেশি পরিমানে কাস্টমার একই সাথে একটি পণ্য অর্ডার করলে সেই পণ্যের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ছাড় পাওয়া যায়৷ 


ইভ্যালি মূলত বিভিন্ন ভাউচার অফার ও ক্যাশব্যাকের মাধ্যমে কাস্টমারদের কাছ থেকে প্রচুর পরিমানে টাকা অগ্রীম পেমেন্ট নিয়ে নেয়। এরপর ইভ্যালি ম্যানুফাকচারদের কাছে অনেক বেশি পরিমাণে পণ্য একসাথে কিনতে চায়৷ তখন ব্র‍্যান্ডগুলো এত বেশি পরিমাণে পণ্যের অর্ডার পেয়ে তাদের প্রফিট মার্জিন অনেক কমিয়ে দেয় এবং বড়ধরনের ডিস্কাউন্টে তাদের পণ্যগুলো ইভ্যালির কাছে বিক্রি করে। 


ম্যানুফ্যাকচারদের ক্ষেত্রে, পণ্যের দাম নির্ধারনের সময় বেশ কিছু জিনিষের খরচ হিসাব করতে হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে–


Warehouse Cost 

Showroom Cost

Transportation Cost

Dealers Commission 

Salesperson Salary ইত্যাদি। 

ফলে পাইকারি দামে বিপুল পরিমানে পণ্য বিক্রি করে দিতে পারলে ম্যানুফ্যাকচারারদের এমন কিছু বাড়তি খরচ বেঁচে যায়৷ ফলে ইভ্যালিকে ডিসকাউন্ট দিয়ে পণ্য বিক্রি করলেও ব্র‍্যান্ডগুলো তাদের প্রফিট ঠিকই বজায় রাখতে পারে। পাশাপাশি ইভ্যালিও কিছু লাভ করতে পারে।


ইভ্যালি প্রি-অর্ডার মডেল


এই Group Buying মডেলের অংশ হিসেবেই ইভ্যালি মূলত Pre-Order নিয়ে থাকে৷ বিশ্ব জুড়ে প্রি-অর্ডার ভিত্তিক কেনাকাটা খুব সাধারন হলেও বাংলাদেশে এটি কখনোই জনপ্রিয় ছিল না৷ তবে ইভ্যালিই প্রথম এই পদ্ধতির সফল প্রয়োগ দেখিয়েছে। এই মডেল ফলো করেই ইভ্যালি তার ব্যবসার শুরুর দিকে হোম এপ্লায়েন্স, ইলেক্ট্রনিক্স, ল্যাপটপ, গাড়ি সহ যেসব পণ্য মুহুর্তের মধ্যেই জরুরি দরকারী না সেসব পণ্যের উপর বিপুল পরিমাণে ক্যাশব্যাকের অফার দিচ্ছিল। যেহেতু এসব পণ্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মধ্যে পড়ে না তাই কিছু সময় অপেক্ষার পর পণ্য পেয়ে যদি বড় এমাউন্টের ক্যাশ ব্যাক বা ডিসকাউন্ট পাওয়া যায় তাহলে কাস্টমারেরই সুবিধা। সে ধারনা থেকেই ইভ্যালি তাদের প্রি অর্ডারের ধারনাটি কিছুটা চাতুরতার সাথে বাস্তবায়ন করেছে৷ 


কম দামী পণ্যের ক্ষেত্রে ইভ্যালি বেশিরভাগ চাইনিজ ই-কমার্স গুলোকে ফলো করে। তারা অনেক বেশি পরিমাণে পণ্য কিনলে ডিস্কাউন্টের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় একই পণ্যের পরিমাণ বাড়িয়ে বান্ডেল তৈরি করে। এরপর সেই বান্ডেল প্যাকের উপরে ডিস্কাউন্ট অফার করে। যার ফলে কাস্টমারেরা শুধুমাত্র এই অফার নেওয়ার জন্যই তাদের প্রয়োজনের চেয়ে অত্যধিক পরিমাণে পণ্য অর্ডার করে। 


ইভ্যালির সাপ্লায়ার চেইন মডেল


একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কাস্টমারের পাশাপাশি পণ্যের সাপ্লাইয়ার রাও অনেক বড় একটি উপাদান৷ ইভ্যালির সাপ্লায়ার মডেলকে বিশ্লেষন করলে এদের তিন ক্যাটাগরির সাপ্লায়ার রয়েছে৷ তারা হলো–


১৷ তুলনামূল বড় ব্র‍্যান্ডের সাপ্লায়ার৷ এরা নিজেদের স্টোর নিজেরাই ম্যানেজ করে। ইভ্যালির মাধ্যমে অর্ডার নিয়ে এরা পণ্য বিক্রি করে থাকে। 


২। তুলনামূলক মধ্যম মানের ব্র‍্যান্ডগুলো। এদের স্টোর তৈরির ব্যাপারটি ইভ্যালি নিজেই ম্যানেজ করে থাকে। 


৩। ছোট ফিজিক্যাল শপ। যেসব সাপ্লায়ার এর ফেসবুকে বিজনেস বা ছোটখাটো ফিজিক্যাল শপ আছে তাদের ইভ্যালিতে ব্যবসা খোলার সুযোগ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ইভ্যালি মধ্যস্থতাকারী হিসেবে অর্ডার নেয় এবং এসব দোকান থেকে মানুষ পণ্য কিনে থাকে। 


সাপ্লাই চ্যানেলে ইভ্যালির সবচেয়ে বড় সফলতা বলা যেতে পারে ইভ্যালির গ্রোসারি শপ চালু করা। ইভ্যালি গত বছর গ্রোসারি, ফিশ ও মিট সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সেকশন চালু করে। এসময়ে ইভ্যালিতে বড় বড় গ্রোসারি ব্র‍্যান্ড যেমন Swapno, Meena Bazar, UniMart, Bengal Meat সহ ছোট ছোট মুদি দোকানদার ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও ইভ্যালি প্ল্যাটফর্মে যোগ দেয়। ফলে ইভ্যালির সাপ্লাই প্ল্যাটফর্ম সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হয়ে উঠে।  



|| ইভ্যালির উত্থান ও ভবিষ্যত নিয়ে জানতে এই লেখাটি পড়তে পারেন। ||


Tag: মোহাম্মদ রাসেল ইভ্যালি, ই-কমার্স,ইভ্যালি আপডেট,ইভ্যালি অফার,ইভ্যালি সাইক্লোন অফার, evaly order process, tma, tmabd, ইভ্যালির উত্থান, ইভ্যালির ভবিষ্যত,