রাসূলের মেরাজে: কী ঘটেছিল সে রাতে? (দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব) | Incident of Miraj

 




লেখা: Tma Islam desk 


মে'রাজ রাসূল (সাঃ) এর জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা৷ এই ঘটনা রাসূলের মক্কী জীবনে সংঘটিত হয়। নির্দিষ্ট তারিখ নিয়ে মত পার্থক্য থাকলেও বলা হয়ে থাকে, ২৭ শে রজব রাতে মে'রাজ সংগঠিত হয়েছিল। 


দুই পর্বের লেখায় মেরাজ সম্পর্কিত বিস্তারিত ঘটনাবলি জানার চেষ্টা করবো। আজ থাকছে দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব। 


 প্রথম পর্বের লিঙ্ক এখানে । 



বাকি আসমানগুলোয় রাসূলের ভ্রমণ 


পরের পাঁচ আসমানে রাসূলের সাথে বেশ কয়েকজন নবীর দেখা হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হযরত ইয়াহইয়া (আঃ), হযরত ঈসা (আঃ), হযরত ইউসুফ (আঃ), হযরত হারুণ (আঃ) এবং হযরত মূসা (আঃ)।  


সপ্তম আসমানে রাসূল (সাঃ) বিরাট এক প্রাসাদ ও বাইতুল মা'মুর দেখতে পান। বাইতুল মা'মুরের চারদিকে ৭০ হাজার ফেরেশতা তাওয়াফ করছিলো। এরা সকলে একবারই তাওয়াফের সুযোগ পান। প্রাসাদটির কাছে তিনি হযরত ইবরাহীম (আঃ) কে দেখতে পান। 



সিদরাতুল মুনতাহায় রাসূল 


রাসূলকে আসমান ছাড়িয়ে আরো উপরের স্থান 'সিদরাতুল মুনতাহা'য় নিয়ে যাওয়া হয়। এই স্থানটিকে আল্লাহর আরশ এবং তাঁর সৃষ্টিজগতের মধ্যে শূন্য একটি এলাকা হিসেবে দেখা হয়। রাসূল (সাঃ) দেখতে পান, এই স্থানটিতে এসে ফেরেশতারা প্রয়োজনীয় বার্তা বা আদেশ নিয়ে ফিরে যান। এর উপরে যাওয়ার অনুমতি নেই তাদের। এমনকি জিবরাইল (আঃ) ও এর উপরে আর যেতে পারেন না। 

মেরাজের পুরো পথ



রাসূলকে এই স্থানেই নেক লোকদের উদ্দেশ্যে তৈরি বেহেশত এবং তাদের জন্য রাখা পুরষ্কার দেখানো হয়। এর আগে আর কোনো নবীর এটি দেখার সৌভাগ্য হয় নি।  


জান্নাত পরিদর্শনকালে জিবরাঈল (আ.) হাত দিয়ে নবীজীকে জান্নাতে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট ঘরটি দেখান। নবীজী ঘরটিতে যেতে চাইলে জিবরাঈল (আ.) বলেন, ‘হুযূর পৃথিবীতে আপনার এখনো হায়াত আছে। তাই এখন আপনি যেতে পারবেন না ঐ ঘরে।’


জিবরাইলকে বিদায় জানান রাসূল। পরের পথটি রাসূলকে যেতে হবে একাই৷ 


আল্লাহর সান্নিধ্যে রাসূল (সাঃ) 


সিদরাতুল মুনতাহা থেকে আরো উপরের দিকে যেতে শুরু করেন প্রিয় নবী। এ সময় যান হিসেবে রফরফ নামে আরেকটি বাহন ব্যবহ্রত হয়েছিল। এক পর্যায়ে উঁচু সমতল একটি স্থানে পৌঁছালে তিনি আল্লাহর দরবারে নিজেকে উপস্থিত দেখতে পান।  



সাক্ষাত্‍কালে রাসুল (সাঃ) আল্লাহর কতটা নিকটবর্তী ছিলেন সে সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,

“ফলে, তাদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রইল।” (সূরা নাজম্ : আয়াত ৯) 



কী আলোচনা হয়েছিল আল্লাহর সাথে? 


মূলত চারটি বিষয়ে রাসূলের আলোচনা হয় মহান আল্লাহর সাথে। 


১। দৈনিক ৫০ ওয়াক্ত নামাজ বাধ্যতামূলক আদায়। 


২। কোরআনের সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত নাযিল। 


৩। শিরক গুনাহ ব্যতীত অন্যান্য সকল গুনাহ মাফের সম্ভাবনা ঘোষণা করা হয়।  


৪। কোনো ব্যক্তি একটি নেক কাজের নিয়ত করলে তার আমলনামায় ১ টি নেকী এবং কাজটি সম্পন্ন করলে ১০ টি নেকী লেখা হবে। কোনো ব্যক্তি একটি খারাপ কাজের নিয়ত করলে তার আমলনামায় কোনো গুনাহ লেখা হবে না এবং কাজটি সম্পন্ন করলে ১ টি গুনাহ লেখা হবে।  



৫০ ওয়াক্ত থেকে যেভাবে পাঁচ ওয়াক্ত


রাসূল (সাঃ) আল্লাহর শিক্ষা ও বাণী লাভ করার পর বিদায় নিয়ে নিচে নামতে শুরু করেন। পথে দেখা হয় হযরত মূসা (আঃ) এর সাথে। সব শুনে মূসা বলেন, বনী ইসরাইলের সাথে আমার তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, আপনার উম্মতেরা দৈনিক ৫০ ওয়াক্ত নামাজের বোঝা বহন করতে পারবে না। তিনি ওয়াক্ত সংখ্যা কমিয়ে আনার পরামর্শ দেন।

নামাজ আদায় করছেন মুসুল্লিরা



 রাসূল (সাঃ) ফিরে যান আল্লাহর দরবারে। আল্লাহকে অনুরোধ করেন ওয়াক্ত সংখ্যা কমাতে। মহান আল্লাহ ১০ ওয়াক্ত কমিয়ে দেন। ৪০ ওয়াক্তের আদেশ নিয়ে রাসূল (সাঃ) ফিরে আসেন। আবার মূসা (আঃ) এর সাথে দেখা হলে মূসা বলেন, এই সংখ্যাও অত্যধিক। তাই মূসার পরামর্শ মেনে আবার ফিরে যান আল্লাহর কাছে, অনুরোধ করেন ওয়াক্ত সংখ্যা আরো কমাতে।   


এভাবে প্রতিবারে ১০ ওয়াক্ত করে আর শেষবারে পাঁচ ওয়াক্তে কমানো হলো নামাজ।


হযরত মুসা (আ.) এবারও ফিরে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিলেন। নবীজী বললেন, আমার আর যেতে লজ্জা লাগে। তখন গায়েবিভাবে ঘোষণা আসে, যারা এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ

আদায় করবে তাদেরকে পঞ্চাশ ওয়াক্তের সওয়াব দেওয়া হবে।  


আল আকসায় ফিরে আসা 


ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ এই সফর শেষে একই মই দ্বারা রাসূল (সাঃ) আল আকসা মসজিদের আঙ্গিনায় নেমে আসেন। সকল আম্বিয়ায়ে কেরাম সেখানে উপস্থিত ছিলেন। রাসূল (সাঃ) তাঁদের নিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করেন। তারপর তিনি বোরাকে চড়ে মক্কায় ফিরে আসেন। 


মক্কাবাসীর প্রতিক্রিয়া


 সকালে রাসূল (সাঃ) সর্বপ্রথম চাচাতো বোন উম্মে হানির কাছে এই ঘটনা বর্ণনা করেন। তিনি অন্যদের কাছেও এই ঘটনা বর্ণনা করার ইচ্ছে প্রকাশ করলে উম্মে হানি তাঁকে বাধঁা দিতে চান। কারণ তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন তাঁর এই ঘটনা অন্যদের কাছে কৌতুক মনে হবে। রাসূল তবু তাঁর ইচ্ছেতে অটল ছিলেন। 


তিনি বের হলেন মানুষকে এই ঘটনা জানাতে। সবার আগে তাঁর সাথে হারাম শরীফে দেখা হলো আবু জাহলের। সে কৌতুক করে বললো, নতুন কোনো খবর আছে না কি? প্রিয় নবী প্রতিত্তোরে হ্যাঁ বলে জানালেন, গতরাতে তিনি জেরুজালেমে ছিলেন। আবু জাহল এ কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়লো। সে রাসূলের মত নিয়ে মানুষকে জড়ো করতে লাগলো, উদ্দেশ্য সকলকে এই খবর জানানো। 




সকলকে এই ঘটনা বলার পর কেউই বিশ্বাস করতে পারে নি। তারা বলেন, দুই মাসের সফর এক রাতে?? এটি অবিশ্বাস্য ঘটনা। আমরা আগে ভাবতাম আপনি পাগল। এখন তা নিশ্চিতভাবেই প্রমাণ হলো। 


কিছু লোক হযরত আবু বকর (রাঃ) এর কাছে গিয়ে ঘটনাটির সত্যতা জানতে চায়। আবু বকর ঘটনা শুনে অবিশ্বাস করেন নি। তিনি আল্লাহর রাসূলকে অগাধ বিশ্বাস করতেন। তিনি তাই মোটেও আশ্চর্য হন নি। 



কীভাবে প্রমাণ হয়েছিল মেরাজের সত্যতা? 


আবু বকর তৎক্ষনাৎ রাসূলের কাছে যান। তিনি প্রিয় নবীকে বলেন, আমি জেরুজালেম ও সেখানকার মসজিদ দেখেছি। আপনি দয়া করে বলুন সেগুলো কী রকম? 


সবাই জানতো রাসূল (সাঃ) এর আগে কখনো জেরুজালেমে সফর করেন নি। কিন্তু তিনি এমনভাবে জেরুজালেমের বর্ণনা দিলেন যেন শহরটি তাঁর চোখের সামনে ভাসছে। রাসূলের মুখে যথার্থ বর্ণনা শুনে সন্দেহকারীরা তাদের মত পুনর্বিবেচনা করে। তারা আরো বেশি প্রমাণ চাচ্ছিলো। রাসূল (সাঃ) তাও দিলেন, তিনি যাওয়ার পথে অমুক অমুক কাফেলাকে অমুক অমুক দ্রব্য সহকারে বোরাকের পাশে দেখেছেন। একটি উট উপত্যকায় দৌড়ে চলে গিয়েছিল। সে খবর তিনি কাফেলার লোকদেরও দিয়েছিলেন। রাসূল প্রত্যাবর্তনের সময়কার কথাও বলেছেন, " আমি অমুক উপত্যকায় অমুক লোকদের দেখেছি। তারা ঘুমাচ্ছিল। আমি একটি পাত্র থেকে পানি পান করে এর নমুনা রেখে এসেছি। "



পরবর্তীতে রাসূলের বর্ণনার সত্যতা অনুসন্ধানে তাঁর উল্লেখ করা কাফেলাদের মক্কা আনা হয়। তারা সকলে রাসূলের বর্ণনার পক্ষে মত দেন এবং সত্য বলে স্বীকার করেন। 



ফলে আর কোনো সন্দেহ থাকে নি মেরাজের ঘটনা সম্পর্কে।  


সমাপ্ত।।। 




তথ্য: TmA Library Team


ট্যাগ: বিশ্বনবীর মেরাজ, মেরাজের অলৌকিক ঘটনা, মেরাজ শব্দের অর্থ কি, মেরাজের ঘটনা বাংলা, বিশ্ব নবীর মেরাজের ঘটনা, মেরাজের বিস্ময়কর ঘটনা, মেরাজের ঘটনা, শবে মেরাজ কবে