লেখা: Tma Islam desk
মে'রাজ রাসূল (সাঃ) এর জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা৷ এই ঘটনা রাসূলের মক্কী জীবনে সংঘটিত হয়। নির্দিষ্ট তারিখ নিয়ে মত পার্থক্য থাকলেও বলা হয়ে থাকে, ২৭ শে রজব রাতে মে'রাজ সংগঠিত হয়েছিল।
দুই পর্বের লেখায় মেরাজ সম্পর্কিত বিস্তারিত ঘটনাবলি জানার চেষ্টা করবো। আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
মোট ২৮ জন সাহাবী রাসূলের মেরাজের ঘটনা সম্পর্কিত হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাদের মধ্যে সে সময় মক্কায় ছিলেন ৭ জন এবং বাকিরা পরবর্তীতে রাসূলের কাছ থেকে মেরাজের ঘটনা শুনেছেন৷
যমযমের পানিতে শুদ্ধতা
রাসূল (সাঃ) এর বয়স তখন ৫২ বছর। একদিন তিনি কা'বা শরীফের পাশে ঘুমিয়েছিলেন। জিবরাইল (আঃ) তাঁকে ডেকে তোলেন। আধা জাগ্রত অবস্থায় তাঁকে যমযম কূপের স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। জিবরাইল (আঃ) তাঁর বুক চিরে ভেতরের অংশ যমযমের পানি দিয়ে ধুয়ে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিশ্বাস ও দূরদর্শিতা দিয়ে তাঁর বুক পুনঃস্থাপিত করেন।
![]() |
মক্কা |
বোরাক নামের পশু
তারপর তাঁর সামনে বোরাক নামে একটি পশু আনা হয়। বোরাকের গায়ের রং ছিল সাদা এবং এটি উচ্চতায় খচ্চরের চেয়ে কিছুটা খাটো ছিল।
বোরাক দ্রুততায় আলোর গতিসম্পন্ন ছিল।
রাসূল (সাঃ) যখন বোরাকে আরোহণ করতে গেলেন তখন পশুটি নিজেকে সংকুচিত করে সওয়ার হতে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করে। পরে জিবরাইল (আঃ) বোরাককে বলেন, " সাবধান! ইতোপূর্বে মুহাম্মদের চাইতে কোনো শ্রেষ্ঠ মানুষ তোমার উপর আরোহণ করেন নি। " এরপর রাসূল (সাঃ) বোরাকের উপর আরোহণ করেন, জিবরাইলের সাথে শুরু হয় তাঁর সফর।।
যাত্রাবিরতি
মদিনায় তাঁরা প্রথম যাত্রাবিরতি করেন। নামায আদায় করেন। জিবরাইল (আঃ) সে সময় রাসূল (সাঃ) কে বলেন, এটিই হবে তাঁর হিজরতের স্থান। মক্কা ত্যাগ করে পরে তাঁকে এখানে আসতে হবে।
দ্বিতীয়বার তাঁরা যাত্রাবিরতি করেন সিনাই পাহাড়ে। মুসা (আঃ) আল্লাহর সাথে এই পাহাড়েই কথা বলেছেন। তৃতীয়বার যাত্রাবিরতি করেন হযরত ঈসা (আঃ) এর জন্মস্থান বেথেলহামে। স্থানটি ফিলিস্তিনের পশ্চিম জেরুজালেমে অবস্থিত।
![]() |
সিনাই পাহাড় |
চতুর্থবার যাত্রা বিরতি করেন পূর্ব জেরুজালেমের বাইতুল মাকদিস বা আল- আকসা মসজিদে। এখানেই বোরাকের সফর শেষ হয়। বোরাককে মসজিদের পশ্চিমের দেয়ালের সাথে বাঁধা হয়। এই দেয়ালের নাম পরে 'বোরাক দেয়াল' দেয়া হয়।
![]() |
বোরাক দেয়াল |
বিভ্রান্ত করার চেষ্টা ছিল
সফরকালে রাসূল (সাঃ) কে একজন ডেকে বললো, "এখানে আস। " কিন্তু রাসূল (সাঃ) সেদিকে নজর দিলেন না। জিবরাইল (আঃ) বললেন, ঐ ব্যক্তি আপনাকে ইহুদীবাদের দিকে ডাকছে।
অন্য দিক থেকে আরেকজন ডেকে বললো, "এদিকে আস"। রাসূল (সাঃ) এবারও প্রত্যাখ্যান করলেন ডাক। জিবরাইল (আঃ) বললেন, ঐ ব্যক্তি আপনাকে খ্রিস্টবাদের দিকে ডাকছে।
তারপর আকর্ষণীয় পোশাকে সুসজ্জিত এক নারী রাসূলকে নিজের দিকে ডাকলেন। রাসূল (সাঃ) চোখ ফিরিয়ে নিলেন। জিবরাইল (আঃ) বললেন, এ হচ্ছে দুনিয়া।
তারপর একজন বৃদ্ধ মহিলা রাসূলের সামনে এসে হাজির হন। জিবরাইল বললেন, এই বৃদ্ধার অবশিষ্ট বয়স দেখে আপনি এই দুনিয়ার বয়স আন্দাজ করতে পারবেন।
শেষে আরেক ব্যক্তি রাসূলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন। কিন্তু রাসূল (সাঃ) সেদিকে নজর দিলেন না। জিবরাইল (আঃ) বললেন, ঐ ব্যক্তি শয়তান, যে আপনাকে আপনার পথ থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা করছে।
আল আকসায় রাসূল
বোরাককে দেয়ালের সাথে বাঁধার পর রাসূল (সাঃ) যখন আল আকসায় প্রবেশ করেন তখন সেখানে সকল নবীকে উপস্থিত দেখতে পান। রাসূল (সাঃ) এর ইমামতিতে জামাতে নামাজ আদায় করেন তাঁরা।
![]() |
আল আকসা প্রাঙ্গণ |
নামাজ শেষে তাঁর কাছে তিনটি পাত্র আনা হয়। একটিতে ছিল পানি, আরেকটিতে দুধ এবং অন্যটিতে মদ। রাসূল (সাঃ) সেখান থেকে দুধ পান করেন।
তারপর একটি মই আনা হয়৷ আরবীতে মই এর মানে 'মেরাজ'। এই সফরের নামকরণও তাই মেরাজ করা হয়। মই এর মাধ্যম রাসূল (সাঃ) ও জিবরাইল (আঃ) উর্ধ্বাকাশে গমন শুরু করেন।
প্রথম আসমানে ভয়াবহ দৃশ্য
প্রথম আসমানে পৌঁছুলে সেখানে গেট বন্ধ পাওয়া যায়৷ পাহারায় থাকা ফেরেশতার জিজ্ঞাসার উত্তরে জিবরাইল তাঁর নিজের পরিচয় দেন। সাথে কে জিজ্ঞেস করায় জিবরাইল বলেন, মুহাম্মদ। এরপর আবার জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি আমন্ত্রিত কি না। জিবরাইল হ্যাঁ সূচক উত্তর দেওয়ার পর গেট খুলে দেয়া হয়। সেখানে উপস্থিত অন্যান্য ফেরেশতা এবং নেককার ব্যক্তিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।
রাসূল (সাঃ) সেখানে এক ব্যক্তিকে দেখতে পান যার চারপাশে বহু লোকের জটলা ছিল। তিনি ডানে তাকিয়ে হাসেন আর বামে তাকিয়ে কাঁদেন। রাসূল (সাঃ) এর কারণ জিজ্ঞেস করায় জিবরাইল বলেন, তারা সকলে আদম সন্তান৷ ডানের নেক লোকদের দিকে তাকিয়ে তিনি খুশী হন আর বামের পাপী লোকদের দিকে তাকিয়ে দুঃখিত হন।
রাসূল (সাঃ) এক ময়দানে দেখতে পান, কিছু লোক ফসল কাটছে। যতোই কাটা হয়, ততোই নতুন করে জন্মায়। রাসূলের জিজ্ঞাসার উত্তরে বলা হয়, তারা আল্লাহর রাস্তায় জেহাদকারী লোক।
রাসূল (সাঃ) দেখলেন, কিছু লোক নিজেদের মাথায় পাথর দিয়ে অব্যাহতভাবে আঘাত করছে। রাসূলকে বলা হয়, তারা ঐ সকল গোঁড়া লোক যারা নামাজের জন্য ঘুম থেকে উঠতো না।
আল্লাহর নবী আরেক দল লোককে দেখতে পান যারা জামার সামনে পেছনে তালি লাগিয়েছে। তারা পশুর মতো মাঠে চরে ঘাস খাচ্ছে। রাসূলকে বলা হয়, তারা নিজেদের সম্পদ থেকে যাকাত বা দান করতো না।
রাসূল (সাঃ) এক লোককে কাঠ যোগাড় করে বোঝা বাঁধতে দেখতে পান। যখন সেটি ওজনে ভারী হয় তখন আরো কাঠ তাতে যোগ করেন তিনি। তারপর তা বহন করেন। রাসূলের কাছে সেটি কৌতূহলোদ্দীপক মনে হয়। তাঁকে বলা হয়, এই লোক নিজের সামর্থ্যের বাইরে দায়িত্ব নিয়েছিল এবং দায়িত্ব কমানোর পরিবর্তে নতুন করে আরো দায়িত্ব নিয়েছিল এবং ব্যর্থ হয়েছিল।
রাসূল (সাঃ) কিছু লোককে দেখেন কাঁচি দিয়ে নিজেদের জিহবা ও ঠোঁট কাটছে। তাঁকে জানানো হয়, এ সকল লোক দায়িত্বহীন কথা বলে মানুষের দুঃখ বাড়িয়ে দিয়েছিল।
রাসূল এক স্থানে দেখলেন, পাথরের ভেতর থেকে একটি ষাঁড় বেরিয়ে আসছে। তারপর ষাঁড়টি পুনরায় পাথরের ভেতরে ঢুকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছে। রাসূলকে জানানো হয়, এটি সেই সকল লোকের উদাহরণ যারা ভেবে চিন্তে কথা না বলে পরে ক্ষতি উপলব্ধি করে তা প্রত্যাহারের ব্যর্থ চেষ্টা চালায়।
রাসূল (সাঃ) এক জায়গায় দেখতে পান, কিছু লোক নিজের শরীরের গোশত কেটে নিজেই খাচ্ছে। তাঁকে বলা হয়, এরা অন্যের ব্যাপারে অপমানজনক কথা বলতো। তিনি এর মধ্যে আবার কিছু লোককে আঙ্গুলে তামার নখ পরে নিজের শরীরে অব্যাহত আঘাত করতে দেখেন। রাসূলকে বলা হয়, এরা নিন্দুক, মানুষের ব্যাপারে নিন্দা ও গীবত করে বেড়াতো।
তিনি দেখেন কিছু লোকের ঠোঁট উটের মতো বড়। এরা আগুন গিলে খাচ্ছে। রাসূলকে বলা হয়, এরা ইয়াতীমের মাল ভোগ করেছিল।
প্রিয় নবী কিছু লোককে দেখতে পান, যাদের সাপভর্তি বড় বড় পেট। তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রমকারীরা তাদেরকে পদদলিত করে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের নড়াচাড়া করার শক্তি নাই। এরা সুদখোর।
তিনি কিছু লোককে দেখতে পান, যাদের এক পাশে পরিষ্কার গোশত এবং অন্য পাশে পঁচা দুর্গন্ধযুক্ত গোশত। এরা ভালো গোশত না খেয়ে পচঁা গোশত খাচ্ছে। রাসূলকে বলা হয়, এরা বিবাহিত যেনাকারী নারী ও পুরুষ।
রাসূল কিছু নারীকে দেখলেন তাদেরকে তাদের স্তনের সাথে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তাঁকে জানানো হয়, এরা তাদের সন্তানকে আসল জন্মদাতা পিতার পরিবর্তে অন্য পুরুষের সন্তান বলে চালিয়ে দেয়।
প্রথম আসমানে ভ্রমণকালে রাসূলকে সকল ফেরেশতাই অত্যন্ত খুশী ও আনন্দ সহকারে স্বাগত জানান। কিন্তু ভ্রমণের এক পর্যায়ে রাসূলকে একজন ফেরেশতা শান্তভাবে স্বাগত জানান। রাসূলকে বলা হয়, ইনি দোজখের রক্ষক ফেরেশতা।
রাসূল (সাঃ) দোজখ দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলে তাঁর চোখের পর্দা তুলে দেন জিবরাইল (আঃ)। রাসূল (সাঃ) দোজখের ভয়াবহ রূপ প্রত্যক্ষ করেন।
বাকি অংশ দ্বিতীয় পর্বে.... আগামীকাল। চোখ রাখুন TmA Facebook Page এ।
তথ্য: TmA Library Team
ট্যাগ: বিশ্বনবীর মেরাজ, মেরাজের অলৌকিক ঘটনা, মেরাজ শব্দের অর্থ কি, মেরাজের ঘটনা বাংলা, বিশ্ব নবীর মেরাজের ঘটনা, মেরাজের বিস্ময়কর ঘটনা, মেরাজের ঘটনা, শবে মেরাজ কবে