Written by : Tanvir Mahatab Abir
এরপর অনেকবারই যাওয়া হবে ক্যাম্পাসে, কিন্তু একসাথে ঠিক এই মানুষগুলোকে পাওয়া যাবে না, বলা হবে না “আয় সবাই একটা সেলফি তুলি”।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন সকলের কাছেই নানান প্রত্যাশা নিয়ে হাজির হয়। ভর্তিযু্দ্ধে জয়ী হয়ে আসা এখানকার প্রতিটা শিক্ষার্থী নিজেদের নতুন করে জানার সুযোগ পায়। পরিচয় ঘটে দেশের নানান প্রান্ত থেকে আসা সহপাঠীদের সাথে, অভ্যস্ত হতে শিখে ভাষা, চিন্তা, চারিত্রিক নানান ভিন্নতায়। আমাদের মতের মিল হয় না, আমরা সময়ের কাছে হেরে যাই, হারাই বেখেয়ালি বিষন্নতায়। তবু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা যেন অফুরান। ডিপার্টমেন্টের করিডোরে, বাসের আড্ডায়, পুকুর পাড়ের ছায়ায় কিংবা হালের শান্তি নিকেতনের এখানে ওখানে স্মৃতির রং ছড়িয়েছে। আমরা হেসেছি একসাথে, কষ্ট আমাদের মন থেকে মনে ছুঁয়ে গিয়েছে। আচ্ছা, কখনো কি হিংসেও আমাদের পথচলায় বাঁধ দিয়েছিল? কি জানি!
একটা সিটের আকাঙ্খা : ভাগ্য যেভাবে সাহায্য করেছিল আমায়
গল্পটা শুধু বন্ধুত্বের মাঝেই আটকে থাকার কথা ছিল না, তেমন অবশ্য হয়ও নি। ছড়িয়েছে নানান আঙ্গিনায়। যারা শিক্ষা দিয়েছেন, অনুপ্রাণিত করেছেন বিষন্নতার দিনগুলোয়, দেখিয়েছেন স্বপ্ন জয়ের পথ সেই শিক্ষকদের কথা না বললে বোধহয় এই গল্পটা অপূর্ণই ঠেকবে। আমার শিবলুর স্যারের (শিবলুর রহমান, বর্তমানে শিক্ষাছুটিতে জাপানে) কথা মনে পড়ে। প্রথম সেমিস্টারে ল্যাব ভাইবায় স্যার আমাকে নিজের সম্পর্কে বলতে বলেছিলেন। আমি বলেছিলাম অবসরে বই পড়া এবং টুকটাক কবিতা লেখার কথা। স্যারের ইচ্ছায় তৎক্ষনাৎ একটি কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলাম। স্যার সেটা পড়ে প্রশংসা করেছিলেন। আমি বলেছিলাম আমি সাধারণত মাথায় যা আসে তা ফেসবুকে লিখি। তিনি বলেছিলেন, “ভালো আইডিয়া। এক কাজ করবা। ফেসবুকে লেখা সব কবিতা একত্র করে বইমেলায় বই পাবলিশ করবা। অনেকেই করে এমন।” আমার সোহেল স্যারের (সোহেল খান, শিক্ষা ছুটিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে) কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে মনজের স্যারের কথাও। ব্যাচের কোর্স সমন্বয়ক তনুজা বড়ুয়া ম্যামের কথা মনে পড়ে। এই ব্যাচটার প্রতিটা শিক্ষার্থীর নাম তার মুখস্থ ছিল, সবাইকে দেখতেন নিজের ভাই বোনের চোখে। আমার মাহবুব স্যারের কথা মনে পড়ে। গবেষণা পাগল এই মানুষটা শিক্ষার্থীদের সাথে মিশতেন বন্ধুর মতে। অফিসের একটি এসাইনমেন্টে বিশেষজ্ঞ মতামত প্রয়োজন হয়েছিল একবার। তিনি সানন্দে আমাকে ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সেটি জাতীয় একটি দৈনিকেও প্রকাশ পেয়েছিল।

কিশোয়ার জাহান চৌধুরী তুলি ম্যাম আমার প্রজেক্ট সুপারভাইজার ছিলেন। আমি যে বিষয়ে কাজ করেছি সেটি নিয়ে আমাদের বিভাগে এর আগে কখনো কাজ হয় নি। এমনকি বাংলাদেশেও হাতেগোনা কয়েকটি জায়গায় এই বিষয়ে কাজ হয়েছে। তাই চ্যালেন্জ ছিল সফল হওয়ার। ডিফেন্সের আগের দিন তিনি একটি মেইল করেছিলেন আমাকে। লিখেছেন, “এই প্রেজেক্টের জন্য তোমার উৎসাহ, আগ্রহ এবং আকাঙ্ক্ষা আমাকে সত্যিই অবাক করেছে৷” প্রজেক্টের পুরোটা সময় এই মানুষটার পাশে থাকা, পরামর্শ দেওয়া সফল একটি প্রজেক্টের পথে এগিয়ে নিয়েছে আমাকে। আমার ড. মুহম্মদ আবদুস সালাম স্যারের কথা মনে পড়ে। স্যার বরাবরই মেজাজি মানুষ হিসেবে পরিচিত, আমরা ভয়ও পেতাম তাকে। তবে এই মানুষটা শিক্ষার্থীদের কথা ভাবেন, পড়াশোনার মানোন্নয়নে তার প্রয়াস চোখে পড়েছে সবসময়ই। সালাম স্যার আমার লেখালেখিতে বহুবারই অনুপ্রেরণার নিয়ামক হয়েছেন। তার আক্ষেপ ডিপার্টমেন্ট নিয়ে লেখালেখি করি না আমি। ডিফেন্সের দিন সেটাই বলছিলেন। শেষ যখন দেখা হলো, বলেছিলেন, “সাংবাদিক, যোগাযোগ রেখো। ” বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ মহিনুজ্জামান স্যারের সাথে পরিচয় খুব বেশিদিনের নয়। সম্ভবত চট্টগ্রামে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্যুরেই প্রথম আমাকে দেখেন তিনি। আমার সাথে কখনো আলাদা করে কথা হয় নি তার। তবে ট্যুরে যেখানেই গিয়েছি সেখানেই শিক্ষার্থীদের কিছু বলতে বলা হলে তিনি আমাকে সামনে এনেছেন কোনো এক অজানা কারণে। বলেছেন, অভিজ্ঞতার কথা বলতে। ডিফেন্সের দিন তিনিও ছিলেন কমিটিতে। তখনই প্রথম স্যারের সাথে আলাপ করার সুযোগ হলো। স্যার পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে বেশ খানিকক্ষণ খোলামেলা আলোচনা করলেন আমার সাথে। সময় থাকলে হয়তো এই আলোচনা আরও দীর্ঘ হতো। এই শিক্ষকদের সাথে আমার সরাসরি পরিচয় ছিল বিধায় তাদের কথাই উল্লেখ করলাম। আমি কৃতজ্ঞ এই মানুষগুলোর প্রতি। তাদের পরামর্শ, বকা, নির্দেশ এবং অনুপ্রেরণা নিঃসন্দেহে আমার এগিয়ে যাওয়া মসৃণ করবে বলেই আমি বিশ্বাস করি। আমার পড়াশোনায় তেমন কোনো ছাপ রেখে যাওয়ার মতো ফলাফল নেই। আমার মনে হয়, শিক্ষকরা আমাকে যতটুকই চেনেন সেটা লেখালেখির কারণে। আলহামদুলিল্লাহ।

শিক্ষার সবচেয়ে বড় প্লাটফর্ম বোধহয় বিশ্ববিদ্যালয়, কেননা চাকুরী নামের জীবনের সবচেয়ে কঠিন অধ্যায়ে নামার আগে এখানে শেষ ঘষামাজা হয় একজন শিক্ষার্থীর। এখানকার শিক্ষকরা তাই প্রতিটি শিক্ষার্থীর অর্জনগুলোয় বড়সড় অবদানই রাখেন। বিশেষ করে তাঁদের পেরিয়ে আসা কঠিন পথের অভিজ্ঞতা বেশ কাজে দেয় আগামীর পথচলায়। জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার প্রশ্ন যদি আসে তাহলে সেখানটায় এখানকার শিক্ষকদের প্রভাবই বেশি থাকাটা স্বাভাবিক। নৈতিক শিক্ষার কথাটাই বারবার বলে যাই, কারণ পাঠ্য বইয়ের গৎবাঁধা শিক্ষা তো সবাই দিতে পারে, মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিতে পারে ক’জন? একটা শিক্ষাজীবন তো শুধুমাত্র সিজিপিএ কেন্দ্রিক হতে পারে না, হওয়া উচিতও নয়। কৃতজ্ঞতা তাই তাঁদের প্রতি যাঁরা জীবনজুড়ে আত্ম সম্মান বোধ বাঁচিয়ে রেখে মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিয়ে গেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, আঞ্চলিক নানান টানাপোড়েন শিক্ষকদের কাজে বাধা হয়ে আসে এটা যেমন সত্যি ঠিক তেমনি এটাও সত্যি যে আন্তরিকতা থাকলে এগিয়ে যাওয়া বাধা হয়ে থাকতে পারে না। আমি বিশ্বাস করি, আন্তরিকতার জায়গায় সর্বোচ্চ দায়বদ্ধতার পরিচয় রাখবেন মানুষ গড়ার কারিগরেরা।
আমার ‘গাতা’ (মেসের নাম) জীবনের কথা মনে পড়ে। নোয়াখালীতে আমাকে কখনো মেস খুঁজতে হয় নি। প্রথম যেদিন ক্লাস করতে গিয়েছিলাম সেদিনই স্কুলের বন্ধুদের মেসে গিয়ে উঠেছিলাম। এখানেই মেসজীবনের পুরোটা কেটেছে। মনে পড়ে ডেমু ট্রেনের কথাও। কতবার যে টিকেট ছাড়া এই ট্রেনে গিয়েছি তার কোনো হিসেব নেই। তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, এই ট্রেন না থাকলে বাসা থেকে ক্যাম্পাসে যাওয়াটা এত সহজ হতো না।

জুনিয়রদের সাথে সেভাবে কখনো সখ্যতা গড়ে ওঠে নি আমার। তবে কমবেশি সবার মুখই চেনা ছিল। তাদের আন্তরিকতা আনন্দ দিয়েছে সময়ে সময়ে। আমি বিশ্বাস করি, মানুষের প্রতি মুগ্ধতা কিংবা ভাল লাগাটা এমন কোনো আহামরি কোনো ব্যাপার থেকে আসে না। মুগ্ধতা প্রকাশ পায় ভাল ব্যবহারে, ব্যক্তিত্বে এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধে।
চার বছরের অনার্স জীবনে সাড়ে পাঁচ বছরে গিয়ে ঠেকেছিল। শুধু কি কোভিডই দায়ী ছিল তার জন্য? অনেক চড়াই উতরাই দেখার এই সময়টায় আমি মানুষের বদলে যাওয়াতে অভ্যস্ত হতে শিখেছি। দেখেছি স্বাচ্ছন্দ্য খোঁজার কী তীব্র হাহাকার! আমি মতের দ্বন্দ্বে বন্ধুদের গ্রুপ ভাগ হয়ে যেতে দেখেছি। আমি ঐক্যের জায়গায় স্বার্থ টানতে দেখেছি। পারস্পরিক স্বার্থপরতা আমাদের হারিয়ে দিচ্ছিলো প্রতিনিয়ত। নিঃস্বার্থ আবেগের অসহায়ত্ব দেখেছি সময়ের বাঁকে। বিনয়ী হওয়ার শিক্ষার সময়ে আমরা অন্যকে নিয়ে মজা করার হাজারটা উপায় শিখেছি।
তবু সব কিছু পেছনে ফেলে স্মৃতির ক্যানভাসে আনন্দের স্মৃতি থাকুক, টিকে থাকুক পারস্পরিক সম্পর্কের উপাখ্যান।
০৮ মার্চ ২০১৭ – ০৫ জুলাই ২০২২