Written by : Tanvir Mahatab Abir
হ্যাশট্যাগ মূলত হ্যাশ চিহ্নের (#) সাথে এক বা একাধিক শব্দ জুড়ে দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করার ব্যবস্থা। হ্যাশট্যাগ সাধারণত ব্যবহার করা হয় কোনো একটি নির্দিষ্ট ইস্যু বা টপিকের লেখা একসাথে খুঁজে পেতে। একাধিক মানুষ যখন একই হ্যাশট্যাগে পোস্ট দেন তখন সেই হ্যাশট্যাগে ক্লিক করলেই সকল পোস্ট একসাথে সামনে আসে। এমন করে বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে একই টপিকের সকল পোস্ট দেখা যায় মাত্র এক ক্লিকেই। কোনো একটি ইস্যু ভাইরাল করতে সাম্প্রতিক সময়ে এই ব্যবস্থাটিকে বেশ কার্যকর হিসেবে দেখা হচ্ছে।
কীভাবে এলো হ্যাশট্যাগ?
২০০৭ সালের ২৪ আগস্ট৷ মাইক্রো ব্লগিং মাধ্যম টুইটারে ক্রিস ম্যাসিনা নামে সিলিকন ভ্যালিতে একটি ইন্টারনেট কনসাল্টিং কোম্পানির মালিক প্রথম হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করেন তার টুইটে। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন এই হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে তার আগ্রহের বিষয়টিতে অন্যরা কী ভাবছে। টুইটারে তখন হ্যাশট্যাগের প্রচলন ছিল না। তাই তার চেষ্টাও বৃথাই হলো।
২০০৯ সালে নিজেদের সিদ্ধান্ত থেকে শুরু আসে তারা। সে বছর Trending Topics নামে একটি টুল যুক্ত করা হয় টুইটারে, যার মাধ্যমে কোন হ্যাশট্যাগ সেই মুহূর্তে বেশি ব্যবহার হচ্ছে তা জানা যায়। এটি এখনো আছে টুইটারে৷ এরপরই বৈশ্বিক জনপ্রিয়তা পায় হ্যাশট্যাগের ব্যবহার। তখনও অবশ্য অন্য কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এর ব্যবহার ছিল না।
২০১০ সালে চালু হওয়ার প্রথম দিন থেকেই ইন্সটাগ্রামে হ্যাশট্যাগের ব্যবহার শুরু হয়। ২০১৩ সালে ফেসবুকেও হ্যাশট্যাগের ব্যবহার শুরু করেন এর ব্যবহারকারীরা। যদিও টুইটারের বাইরে অন্য কোনো মাধ্যমে হ্যাশট্যাগ নিয়ে আলাদা কোনো টুল নেই।
কোন মাধ্যমে বেশি কার্যকর হ্যাশট্যাগ ?
হ্যাশট্যাগ সবচেয়ে বেশি কার্যকর টুইটারে। অন্তত বিভিন্ন জরিপ তাই বলছে। জরিপ বলছে, হ্যাশট্যাগ দিয়ে করা একটি টুইট হ্যাশট্যাগ ছাড়া একটি টুইটের তুলনায় দ্বিগুণ মানুষের কাছে বেশি পৌঁছায়। তবে টুইটারে একই পোস্টে যদি দুইয়ের বেশি হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করা হয় সেক্ষেত্রে অডিয়েন্স এনগেজমেন্ট কমে যায় প্রায় ১৭ শতাংশ। এজন্য টুইটার কর্তৃপক্ষ তাদের সেটিংসেই দুইয়ের অধিক হ্যাশট্যাগ ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করার কথা বলে রেখেছে।
২০১২ সালে টুইটার কর্তৃপক্ষ নিজেদের এক গবেষণায় দেখেছে, ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট ব্যবহারকারী যারা হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করেন তারা শতভাগ অডিয়েন্স এনগেজমেন্ট পেয়ে থাকেন। ব্রান্ডের ক্ষেত্রে এই হার ৫০ শতাংশ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গবেষক ডান জেরিলাও টুইটার নিয়ে এক সমীক্ষায় হ্যাশট্যাগের পক্ষে ইতিবাচক ফল দেখেছেন।
টুইটারের পর হ্যাশট্যাগের কার্যকারীতা দেখা গেছে আরেক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইন্সটাগ্রামেও৷ তবে এখানে টুইটারের মতো মাত্র দুইটি হ্যাশট্যাগে সীমাবদ্ধ থাকলে আপনি কার্যকরী ফল পাবেন না। গবেষণা বলছে, ইন্সটাগ্রামের একটি পোস্টে সর্বোচ্চ অডিয়েন্স এনগেজমেন্ট পেতে আপনাকে ১১ এর অধিক হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করতে হবে। ভাবা যায়!
ফেসবুকে কার্যকরী নয়?
টুইটার বা ইন্সটাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হ্যাশট্যাগ যতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে ঠিক তার উল্টো প্রভাব দেখা যায় ফেসবুক কিংবা লিন্কডইনের মতো প্লাটফর্মে। গবেষণা বলছে, এই দুই সামাজিক মাধ্যমে হ্যাশট্যাগ কোনো প্রভাবই রাখতে পারছে না।
লিন্কডইনের কথাই ধরা যাক। আপনি ক্রমাগত হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে এখানে পোস্ট দিচ্ছেন কিন্তু দেখা গেল এই হ্যাশট্যাগে আর কোনো পোস্টই আসছে না। কারণ লিন্কডইনে সে সুবিধাই নেই। লিন্কডইনে তাই হ্যাশট্যাগ কার্যকরী নয়।
ফেসবুকের ক্ষেত্রে একটা গবেষণার তথ্য তুলে ধরতে চাই। ২০১৩ সালের ১২ জুন যখন হ্যাশট্যাগের ব্যবহার শুরু হয় ফেসবুকে, তার ঠিক মাস তিনেক পরের এক গবেষণায় দেখা যায়, হ্যাশট্যাগ কোনো ইতিবাচক প্রভাবই রাখে নি এই তিন মাসে৷ উল্টো একই পোস্ট হ্যাশট্যাগ ছাড়া দেওয়াতে সেটি আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে৷ তবে সিদ্ধান্ত পৌঁছানোর জন্য তিন মাস খুব কম সময়। তবে পরের বছরের আরেক সমীক্ষায় একটু ভিন্ন ফলের দেখা পাওয়া যায়।
সমীক্ষা বলছে, যারা পোস্টে সর্বোচ্চ দুইটি হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করেছেন তাদের ক্ষেত্রে অডিয়েন্স এনগেজমেন্ট অন্যদের (যারা ৩-১০ এর অধিক ব্যবহার করেছেন) তুলনায় বেশি দেখা গেছে৷ তার মানে হ্যাশট্যাগ কিছুটা হলেও প্রভাব রেখেছে।
২০১৬ সালে বিলিয়নের অধিক ফেসবুক পোস্ট বিশ্লেষণ করা হয় এক সমীক্ষার অংশ হিসেবে। সেখানে দেখা যায়, হ্যাশট্যাগ ছাড়া পোস্ট হ্যাশট্যাগসহ পোস্টের চেয়ে অধিক মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে।
কিন্তু কেনো সামাজিক মাধ্যম হয়েও হ্যাশট্যাগের ক্ষেত্রে ভিন্ন ফল দেখা যায়? বিশ্লেষকরা বলছেন, টুইটারে ট্রেন্ডিং টুল থাকায় কোন হ্যাশট্যাগটি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে সেটি সহজেই জানতে পারছে যে কেউ। ইন্সটাগ্রামেও সীমিত আকারে একই সুবিধা রয়েছে। কিন্তু ফেসবুকে হ্যাশট্যাগের জন্য আলাদা কোনো সার্চ টুল নেই। যার কারণে কোন হ্যাশট্যাগ বা টপিকটি ভাইরাল হয়েছে সেটি মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত জানতে পারছে না যতক্ষণ না তার বন্ধু তালিকার কারো হ্যাশট্যাগসহ পোস্ট তার টাইমলাইনে আসছে। এখন যদি আপনার বন্ধু তালিকায় কেউ না থাকে তাহলে আপনি জানতেও পারবেন না কোন হ্যাশট্যাগ ভাইরাল হলো। ২০১৬ সালে প্রথম ব্যবহারকারীদের জন্য হ্যাশট্যাগ ব্যবহারের গাইডলাইন নিয়ে আসে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। গেল বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ফেসবুক তার ব্যবহারকারীদের পোস্টে হ্যাশট্যাগ ব্যবহারে উৎসাহিত করছে স্বয়ংক্রিয় অ্যালগরিদম দ্বারা।
সাম্প্রতিক সময়ে তাই পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। এখন আপনি ফেসবুকের সার্চ বারে # চিহ্ন দিলেই কিছু ট্রেন্ডিং হ্যাশট্যাগ স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেখা যায়। যদিও এটি সবসময় কাজ করা নিয়ে প্রশ্ন আছে৷ অ্যাপ, লাইট কিংবা ব্রাউজার ভেদেও আলাদা আলাদা ফলাফল আসে। বিশ্লেষকদের মতে, ফেসবুকের যেহেতু ট্রেন্ডিং টুল নেই তাই সার্চবারে এমন রেজাল্ট আসার পেছনে সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ব্যবহারকারীদেরই। ব্যবহারকারীরাই সার্চবারকে ট্রেন্ডিং হ্যাশট্যাগ খোঁজার উপায় হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে৷ ফলে ফেসবুকেও দিনে দিনে হ্যাশট্যাগের কার্যকারীতা বাড়ছে। তবে টুইটারের মতো কার্যকারীতা পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
![]() |
ফেসবুকে হ্যাশট্যাগ কার্যকর করতে...
ফেসবুকে হ্যাশট্যাগকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু ব্যাপার বা শর্ত মাথায় রাখার কথা বলছেন সামাজিক মাধ্যম বিশেষজ্ঞরা।
১। টপিক অনুযায়ী হ্যাশট্যাগ দিতে হবে। অযাচিত হ্যাশট্যাগ পোস্ট রিচ কমিয়ে দেয়।
২। হ্যাশট্যাগ ব্যবহারই করা হয় বন্ধুতালিকার বাইরে অসংখ্য মানুষকে এক কাতারে আনার উপায় হিসেবে। তাই পোস্ট প্রাইভেসি সবসময় পাবলিক রাখতে হবে।
৩। কমেন্ট হ্যাশট্যাগ কখনোই ট্রেন্ডিং টপিককে পরিবেশন করে না। হ্যাশট্যাগ শুধু পোস্টেই কার্যকর হয়। আপনি যখন ট্রেন্ডিং হ্যাশট্যাগে ক্লিক করবেন, তখন শুধু ঐ হ্যাশট্যাগে থাকা পোস্টগুলোই দেখতে পাবেন, কমেন্ট নয়।
৪। একাধিক হ্যাশট্যাগে কোনো কার্যকারীতা নেই ফেসবুকে, সমীক্ষার ফল অন্তত সেটিই জানাচ্ছে৷ সবচেয়ে বেশি কার্যকর দেখা গেছে, মাত্র একটি হ্যাশট্যাগ ব্যবহারে।
৫। মানুষ কোন হ্যাশট্যাগ বেশি দিচ্ছে সেটির বিষয়ে জেনে হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করলে ইতিবাচক ফলের আশা করা যায়। যেমন, #worldcup একটি ট্রেন্ডিং হ্যাশট্যাগ। এখন আপনি যদি #worldcup না লিখে দুটো শব্দকে আলাদা আলাদা হ্যাশট্যাগ (#world, #cup) হিসেবে ব্যবহার করেন, তাহলে আপনার পোস্টটি #worldcup এর ক্লিকে দেখা যাবে না।
হ্যাশট্যাগের কি আসলেই প্রয়োজন আছে?
হ্যাশট্যাগ চালুর এক যুগ পেরিয়ে এসে প্রশ্ন উঠেছে আসলেই প্রয়োজন আছে কি না হ্যাশট্যাগের। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, হ্যাশট্যাগের অপব্যবহার। মনে করুন আপনার একটি কোম্পানি আছে। আপনি সেটির প্রচারণার অংশ হিসেবে সামাজিক মাধ্যমে #makeitawesome নামে একটি হ্যাশট্যাগ দিলেন পোস্টে। আপনার পোস্টে এই হ্যাশট্যাগটি দেখে অন্য কেউ একই হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করলো সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি টপিকের পোস্টে। এতে করে আপনার পোস্টটি গুরুত্ব হারানোর শঙ্কা থাকে। কারণ আপনার হ্যাশট্যাগটির অযাচিত ব্যবহার আপনার প্রচারণামূলক পোস্টগুলো টার্গেট অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছাতে পারবে না। এতে করে হ্যাশট্যাগটির কার্যকারিতাও থাকবে না।
তবু ব্রান্ড প্রোমোটিং কিংবা কোম্পানির প্রচারণায় হ্যাশট্যাগের ব্যবহার অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে বলে অভিমত বিশ্লেষকদের। হ্যাশট্যাগ তাই ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ব্রান্ড প্রোমোটিং এবং সাম্প্রতিক নানান ইস্যুতে।
তথ্যসূত্র:
২. sproutsocial
৪. Buffer
৬. Mav Social
লেখাটি শেয়ার করে অন্যকেও জানার সুযোগ করে দিন। ধন্যবাদ৷।