আইনস্টাইন সম্পর্কিত রহস্য কিংবা বিতর্কের সত্যতা কতটুকু? | Einstein Mystery | TmA
Written by : Tanvir Mahatab Abir
১৯৪৬ সালের পহেলা জুলাই যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক জনপ্রিয় ম্যাগাজিন টাইম এর সাপ্তাহিক সংখ্যার প্রচ্ছদটি বেশ নজর কাড়ে সকলের। ১৯৪৫ সালে জাপানের দুই শহরে ভয়াবহ পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের পর সৃষ্ট মাশরুম সদৃশ মেঘমালার ছবি পেছনে রেখে সামনে আইনস্টাইনের ছবি ও তাঁর বিখ্যাত সূত্র E=mc2 দিয়ে প্রচ্ছদটি সাজানো হয়। টাইমের সেই সংখ্যাটির মূল নিবন্ধে বলা হয়, “…আলবার্ট আইনস্টাইন পারমাণবিক বোমা নিয়ে সরাসরি কোনো কাজ করেননি, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ দুটি দিক বিবেচনায় তিনিই এই বোমাটির জনক: প্রথম দিক, তাঁর উদ্যোগের ফলেই যুক্তরাষ্ট্র বোমা বানানোর গবেষণা শুরু করে, এবং দ্বিতীয় দিক, তাঁর E=mc2 তত্ত্বই এ বোমার আত্মপ্রকাশকে তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব করে তোলে।
আলবার্ট আইনস্টাইন। জার্মানিতে জন্ম নেয়া এই বিজ্ঞানী তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষ অবদান এবং বিশেষত আলোক-তড়িৎ ক্রিয়া সম্পর্কীত গবেষণার জন্য সুপরিচিত। ১৯২১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন আইনস্টাইন। ১৯৯৯ সালে টাইম সাময়িকী আইনস্টাইনকে "শতাব্দীর সেরা ব্যক্তি" হিসেবে ঘোষণা করে। গুণী এই বিজ্ঞানীকে সর্বকালের সেরা পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে মনে করা হয়।
আইনস্টাইনকে মেধার পরিচয় ছোটবেলাতেই পাওয়া গিয়েছিল এমনটা ভাবা ভুল। আইনস্টাইনের বাবা-মা তাঁর পড়াশোনার অক্ষমতা নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলেন। কারণ তিনি কথা বলা শেখার ক্ষেত্রে অন্য শিশুদের তুলনায় খুব ধীরগতির ছিলেন। অন্যান্য শিশুদের এড়িয়েও চলতেন তিনি। ছিলেন উগ্র মেজাজের অধিকারী। আইনস্টাইন যখন প্রথম স্কুলে যেতে শুরু করেন তখন তিনি ভদ্র এবং ভালো ছাত্র হিসেবে নজরে এসেছিলেন সকলের। একজন সৃজনশীল এবং অবিরাম গাণিতিক সমস্যা সমাধানকারী হিসেবে তাঁর নামডাকও ছিল। তবে তিনি মিউনিখ স্কুলের শিক্ষকদের শৃঙ্খলায় ঘেরা জীবন পছন্দ করতে পারতেন না। এর ফলস্বরূপ ১৫ বছর বয়সে তিনি বাদ পড়েন মিউনিখ স্কুল থেকে। তারপরে, তিনি জুরিখের পলিটেকনিক বিদ্যালয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন। ফলাফলে দেখা গেল, তিনি গণিতের অংশটি পাস করেছেন, কিন্তু উদ্ভিদ বিজ্ঞান, প্রাণীবিদ্যা এবং ভাষার বিভাগগুলোতে ব্যর্থ হয়েছেন। আইনস্টাইন দমে যান নি, পড়াশুনা চালিয়ে যান এবং পরের বছর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। ভর্তি হওয়ার পরও গণিত ছাড়া অন্যান্য বিষয় নিয়ে তিনি রীতিমত হিমশিম খেয়ে যান। তাঁর অধ্যাপকরা ভেবেছিলেন যে আইনস্টাইন হয়ত অন্যান্য বিষয়ের দুর্বলতার দরুণ ভবিষ্যতেও বেশ সমস্যায় পড়বেন। এমনকি কিছু শিক্ষক সন্দেহও পোষণ করেছিলেন যে তিনি হয়ত গ্রাজুয়েটই হতে পারবেন না। গ্রাজুয়েট তিনি হয়েছিলেন কিন্তু আমাদের দেশের গোল্ডেন জিপিএ-৫ ধরনের কিছু রেজাল্ট করে নয়। সাদামাটা একটা রেজাল্ট নিয়েই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন।
তাঁর ছেলেবেলার কথা তো জানা গেল এবার চলুন ভিডিওর শুরুতেই পারমাণবিক বোমা বিষয়ক যে ঘটনার কথা বলেছিলাম তার রহস্য জানার চেষ্টা করি।
আপনার কি মনে হয়, আইনস্টাইন কি পারমাণবিক বোমা তৈরিতে সহায়তা করেছিলেন? পৃথিবীময় ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টির উপাদান তৈরিতে তাঁর কি অবদান ছিল?
সময়টা ১৯৩৯ সাল। আইনস্টাইন জানতে পারলেন জার্মানীর রাজধানী বার্লিনে বিজ্ঞানীরা ইউরেনিয়াম পরমাণুর বিভাজন কৌশল বের করতে সক্ষম হয়েছেন। এর প্রেক্ষিতে আইনস্টাইন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টকে একটি চিঠি লিখেন। চিঠিতে তিনি নিকট ভবিষ্যতে ইউরেনিয়াম পদার্থটিকে সম্ভবত শক্তির একটি নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ উৎসে পরিণত করা যাবে বলে আশন্কা প্রকাশ করে রুজভেল্টকে সেদিকে নজর রাখতে অনুরোধ করেন। চিঠিতে আইনস্টাইন ইউরেনিয়াম দিয়ে নতুন ধরনের প্রচণ্ড শক্তিশালী বোমা তৈরি করার সম্ভাবনার কথাও বলেছিলেন। রুজভেল্ট আইনস্টাইনের চিঠির উত্তরে এই বিষয়ে আলোচনা করতে একটি সভা আহ্বান করার কথা জানান আইনস্টাইনকে। পরের দুই বছর আলোচনা আর প্রস্তাবনার মধ্যেই পার করেছে এই ইস্যুটি। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্ল হারবারে আঘাত হানে। ৬টি বিমানবাহী জাহাজ থেকে ৩৫৩টি জাপানি যুদ্ধ বিমান, বোমারু বিমান এবং টর্পেডো বিমান নৌ-ঘাঁটিটিতে একযোগে আক্রমণ করে বসে। চারটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ সাথে সাথেই ডুবে যায়। এছাড়াও আরও চারটি যুদ্ধজাহাজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আক্রমণের এই ভয়াবহতায় চুপ থাকে নি মার্কিন প্রশাসন। সিদ্ধান্ত নেয় পাল্টা আঘাতের। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের মহারণে নিজেদের নাম লেখায় যুক্তরাষ্ট্র। দ্রুততার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সরকার পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রকল্পে হাত দেয়। শুরু হয় 'ম্যানহাটান প্রজেক্ট’ নামের পারমাণবিক বোমা তৈরির মহাযজ্ঞ। ম্যানহাটনে এই বোমা তৈরির মূল প্রজেক্ট স্থাপিত হলেও বোমার নকশা নিয়ে গবেষণা কাজ চলেছে নিউ মেক্সিকোর লস অ্যালামোসে একটি গোপন গবেষণাগারে। এতসব কাজে আইনস্টাইনের কোনো ভূমিকা না থাকলেও শেষদিকে ছোট্ট একটি দায়িত্ব বর্তায় তাঁর কাঁধে। প্রজেক্টের অন্যতম বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ভ্যানেভার বুশ রাসায়নিক যৌগ থেকে একটি আইসোটোপ পৃথক করার সমস্যায় আইনস্টাইনের সাহায্য চাইলে তিনি দুইদিনের চেষ্টায় সেই সমস্যা সমাধান করে দেন। এই প্রকল্পের ফলাফল হিসেবে বিশ্বের প্রথম চারটি পারমাণবিক বোমা তৈরি হয়। এর মধ্যে ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই প্রথম বোমাটির পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে। এই বিস্ফোরণের নাম দেওয়া হয় ‘ট্রিনিটি’। পরের মাস অর্থাৎ আগস্টের ৬ তারিখ দ্বিতীয় বোমা ‘লিটল বয়’ জাপানের হিরোশিমায় ফেলা হয়। এর দিন তিনেক পরই ‘ফ্যাট ম্যান’ নামের তৃতীয় বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটানো হয় জাপানের নাগাসাকিতে। চতুর্থ বোমাটি জাপান আত্মসমর্পণ করায় অব্যবহ্রত রয়ে যায়।
বোমা তৈরি থেকে শুরু করে এর বিস্ফোরণ - কোনোটিতেই আইনস্টাইন জড়িত ছিলেন না। শুধুমাত্র একটি চিঠির জন্য আমৃত্যু তাঁকে নৈতিকতার জায়গায় প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।
চলুন এবার আইনস্টাইনের সাথে জড়িয়ে যাওয়া আরেকটি রহস্যের কথা জানার চেষ্টা করি।
বেশিরভাগ আমেরিকান সরকারী কর্মকর্তাই বিশ্বাস করতেন, আইনস্টাইন সম্ভবত সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির কাজ করছেন।
এই সন্দেহের পেছনে আইনস্টাইনের বিতর্কিত রাজনৈতিক বিশ্বাসকে দায়ী করা হয়ে থাকে। সমাজতন্ত্র, নাগরিক অধিকার এবং পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে তাঁর অগাধ সমর্থন ছিল। উদাহরণস্বরূপ, অনেক কমিউনিস্ট বিরোধী ধর্মীয় যোদ্ধাই বিশ্বাস করতেন, আইনস্টাইন একটি বিপজ্জনক ধ্বংসাত্মক। এফবিআইয়ের তৎকালীন পরিচালক জে এডগার হুভারের মতো কেউ কেউ আইনস্টাইনকে গুপ্তচর বলেও মনে করতেন। এই মনে করা থেকে তাঁর উপর নজরদারিও করা হয়। ২২ বছর ধরে হুভারের এজেন্টরা আইনস্টাইনের ফোনকল ট্যাপ করেছে, তাঁর মেইল বক্স চেক করা হতো নিয়মিত, তাঁর ফেলে দেওয়া আবর্জনায় কি আছে সেটায়ও রাখা হতো নজর। এমনকি তার সচিবের ভাগ্নির বাড়িও তল্লাশি করা হয়েছিল। এতসব কিছুতে একটাই চেষ্টা ছিল, আইনস্টাইনকে কমিউনিস্ট হিসেবে প্রমাণ করা। এফবিআই তাঁকে নিয়ে ১৪২৭ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল।
প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাসী না হলেও আইনস্টাইন নিজের স্বজাতি ইহুদিদের সঙ্গে একটি ঐতিহ্যগত সম্পর্ক অনুভব করতেন এবং প্রায়ই চেষ্টা করতেন ইহুদি বিদ্বেষের বিরুদ্ধে কথা বলতে। ১৯৫২ সালে ইসরায়েলের প্রথম প্রেসিডেন্ট ওয়াইজম্যানের মৃত্যুর পর আইনস্টাইনকে ইসরায়েল সরকারের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হলো ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য। তিনি সবিনয়ে প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দিলেন। তখন তাঁর বয়স ৭৩ বছর। তিনি আনুষ্ঠানিক প্রত্যাখ্যানপত্রে লিখলেন, ‘যথাযথভাবে মানুষের সঙ্গে মেলামেশার স্বাভাবিক প্রবণতা ও অভিজ্ঞতার অভাব আমার রয়েছে, তা ছাড়া আমি বৃদ্ধও হয়ে যাচ্ছি।’
মহান বিজ্ঞানীকে নিয়ে মৃত্যুর পরও কম নাটক হয় নি।
১৯৫৫ সালের এপ্রিল মাসে মৃত্যুবরণ করেন আইনস্টাইন। মৃত্যুর পর তার শরীরটিকে পুড়িয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন তিনি। কিন্তু তার মৃত্যুর পর একটি অঘটনের জন্ম দেন প্রিন্সটনের প্যাথলজিস্ট থমাস হার্ভি। শবদেহের ময়নাতদন্ত করার সময় আইনস্টাইনের মাথার ভেতরের মগজটুকু চুরি করে রেখে দেন তিনি। তিনি আশা করেছিলেন, এ থেকে হয়ত এই মহামানবের মেধার রহস্য জানা যাবে। পরবর্তী সময়ে তিনি এই মগজের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন বিজ্ঞানীর কাছে গবেষণার জন্য প্রেরণ করেন। এই মগজ নিয়ে আশির দশকে অনেক গবেষণা হয়। এসব গবেষণার ফলাফলে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য গবেষকরা দিতে পারেননি। তবে, ১৯৯৯ সালে আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে আলোচিত একটি গবেষনার তথ্য সামনে আসে। বহু বিতর্কিত ওই গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়, আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের প্যারিয়েটাল লোব নামের একটি অংশ সাধারণ মস্তিষ্কের তুলনায় ১৫শতাংশ প্রশস্ত ছিল। এ অংশটিই গণিতের মতো জটিল বিষয়গুলো আইনস্টাইনকে বুঝতে সাহায্য করে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের।
আইনস্টাইন এমন করেই জীবনভর নানা বিতর্ক আর রহস্যের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন।
ট্যাগ: আইনস্টাইন বিতর্ক, পারমাণবিক বোমা, গুপ্তচর আইনস্টাইন, আইনস্টাইনের জীবনী, tma, tmabd, আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক, ইউরেনিয়াম পরমাণু, পার্ল হারবার, আইনস্টাইন রহস্য,