কুমিল্লা মাতৃভান্ডার রসমালাই: ঐতিহ্য ধরে রাখায় এক আস্থার নাম | Matri Vandar Roshmalai | TmA


 

কুমিল্লা মাতৃভান্ডার রসমালাই: ঐতিহ্য ধরে রাখায় এক আস্থার নাম|Matri Vandar Roshmalai|TmA


Written by : Tanvir Mahatab Abir


    টিনের ছাদের নিচে ছোট্ট একটা দোকান ঘর। বাইরে সবসময়ই দূর দূরান্ত থেকে আসা ক্রেতাদের ভীড়, কখনও বিশেষ করে সকালে লাইনও ধরতে দেখা যায় মানুষদের। দোকানের ভেতরে এক পাশে মহাব্যস্ত একজন বিক্রেতা, সারাক্ষণ এক হাতে টাকা গুনে নিচ্ছেন, আরেক হাতে ক্রেতাকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন মোড়কজাত প্লাস্টিকের বাটি। আরেক পাশে সেই কাগুজের মোড়কের ভেতরে থাকা প্লাস্টিকের বাটিগুলো থরে থরে সাজানো। এক কেজি ওজনের সেই কাগজের প্যাকেটে মোড়ানো বাটিগুলোতেই থাকে বিখ্যাত সেই রসমালাই।


ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশের কয়েক কিলোমিটার এলাকায় এবং কুমিল্লা শহরে ‘মাতৃভান্ডার’ নামে বিভিন্ন মিষ্টির দোকান আছে প্রায় আশিটির বেশি। এসব দোকান থেকে আসল রসমালাই ভেবে কিনে প্রায় প্রতিদিনই প্রতারিত হোন দূর দূরান্ত থেকে আসা ক্রেতারা।
তবে লেখার শুরুতেই যে দোকানের চিত্র তুলে ধরলাম সেটিই আসল অর্থাৎ মাতৃভান্ডার রসমালাই।

কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড় থেকে পূর্বদিকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ দূরত্বে মনোহরপুর এলাকায় রাজ রাজেশ্বরী কালী বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে ঐতিহ্যবাহী এই দোকানের অবস্থান।

মাতৃভান্ডারের শুরুর গল্প


বর্তমানে সিটি করপোরশনে রূপ নেয়া কুমিল্লা একসময় ছিল ভারতের বর্তমান রাজ্য ত্রিপুরার অংশ, বর্তমান নোয়াখালীও তখন কুমিল্লার অন্তর্ভুক্ত ছিল। দেশ ভাগের পর ১৯৬০ সালে ত্রিপুরা জেলার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় কুমিল্লা।
ত্রিপুরা রাজ্যে সেসময় মিষ্টি হিসেবে রসগোল্লা ব্যাপক জনপ্রিয়। অনবরত নেড়ে নেড়ে, দুধ জ্বাল দিয়ে গেলে একসময় তা ঘন হয়ে বাদামী রং ধারণ করবে, যার নাম মূলত ক্ষীরের রসা। রসগোল্লা কে আকারে একটু ছোট ছোট করে মার্বেল সাইজ বানিয়ে সেই রসগুল্লি ক্ষীরের ডুবিয়ে দিয়ে নতুন একটি মিষ্টি তৈরি করা হলো। ক্ষীর এবং রসগুল্লির এই মিশ্রণ -এর নাম দেওয়া হলো ‘ক্ষীর ভোগ’। ১৯০০ সালের দিকে এই ‘ক্ষীর ভোগ’ তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। যেহেতু রসগোল্লার দৃষ্টিনন্দন দানা গুনো ক্ষীর বা মালাই মধ্যে ডুব ডুবে, ডুব সাঁতার কাটে, তাই ‘ক্ষীর ভোগ’ নামটি টিকে থাকলো না বেশিদিন। প্রচলিত হয়ে গেলো একটি নতুন নাম। সেটি ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের মিষ্টির ইতিহাসে’র এক নতুন অধ্যায়। অনন্য অপূর্ব, স্বর্গীয় স্বাদের সেই মিষ্টি’টির নাম হয়ে গেলো ‘রস মালাই’।


ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খড়িয়ালার সন্তান, খনিন্দ্র সেন ও মণিন্দ্র সেন দুই ভাই। ১৯৩০ সালে তারা কুমিল্লার কেন্দ্রস্থল মনোহরপুর এলাকায় বিখ্যাত রাজ রাজ্যেশ্বরী কালী মন্দিরটির সামনে একটি মিষ্টির দোকান খুলে বসলেন। দোকানের নাম দিলেন – “মাতৃ ভাণ্ডার”। প্রথম দিকে এই দোকানে চা-নাশতা সবই বিক্রি হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে চাহিদা বেড়ে গেলে শুধু মিষ্টির দোকান হিসেবেই এটি প্রতিষ্ঠা পায়।

মনিন্দ্র সেন কৃতদার ছিলেন। আর খনিন্দ্র সেনের ছিল দুই মেয়ে এক ছেলে, তাঁর বড় ছেলের নাম ছিল শংকর সেনগুপ্ত। দেশ ভাগের আগেই ১৯৪০ সালে পিতার অবর্তমানে দোকানের হাল ধরলেন শংকর সেনগুপ্ত। শংকর সেনগুপ্ত বার্ধক্য জনিত কারণে এখন অসুস্থ। সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাবেক শিক্ষার্থী অনির্বাণ সেনগুপ্ত, ব্যবসার এখন একমাত্র উত্তরাধিকারী।

সাধারণ রেসিপির অসাধারণ স্বাদ


 কুমিল্লা ও এর আশে পাশের বিভিন্ন অঞ্চলের গোয়ালাদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করা হয়। এরপর ওই দুধ চুলার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় জ্বাল দেওয়া হয়। অন্তত দুই ঘণ্টা জ্বাল দেওয়ার পর দুধ ঘন হয়ে ছানায় রূপ নেয়। প্রচলিত মিষ্টি যে উপায়ে প্রস্তুত করা হয় সেভাবেই ছানা’র সাথে ময়দা’র খামির মিলিয়ে বানানো হয় ছোট ছোট দানা। চিনি সহযোগে পানিতে ফুটে, তৈরি হয় ছোট ছোট রসগোল্লা। ২০ লিটার দুধ থেকে প্রায় সাত কেজি পরিমাণ রস দানা পাওয়া যায়। এই রসদানা তুলে এনে মালাইতে মিশিয়ে দিলেই প্রস্তুত রসমালাই। ঘনত্বভেদ এক মণ দুধ থেকে প্রায় ১৪ কেজি’র মতো মালাই উৎপাদিত হয়ে থাকে। দুধের ঘনত্ব যত বেশি হবে, রসমালাই তত বেশি সুস্বাদু হবে। 
স্বাদ আর মানের ব্যাপারে সবসময়ই সচেতন মাতৃভান্ডার কর্তৃপক্ষ।




কুমিল্লার বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক বলছিলেন,

আসল মাতৃভান্ডারের রসমালাইয়ের স্বাদ কেন আলাদা, সেটাই তো রহস্য! এই স্বাদ বলে বোঝানোর মতো না। ঘন ক্ষীরের মধ্য থেকে তুলে ছোট মিষ্টিটি জিবে দিলে যেন আপনাতেই গলে যায় মুখের ভেতর। ক্ষীরটাও অসাধারণ! নকল মাতৃভান্ডারের ক্ষীরের স্বাদ কড়া, কিন্তু এই ক্ষীরটা হালকা মিষ্টি।

তিনি বললেন,

ব্যবসায়িক সততা ওঁদের সবচেয়ে বড় পুঁজি। আখাউড়া- দেবিদ্বার প্রভৃতি অঞ্চল থেকে গরুর খাঁটি দুধ নিয়ে আসেন বিক্রেতারা। সেই দুধ জ্বাল দিয়ে খাঁটি কি না, নিশ্চিত হওয়ার পর কেনা হয়।

মিষ্টি তৈরি করতে গিয়ে সামান্য কোনো ত্রুটির কারণে যদি গুণাগুণ নষ্ট হয়, তাহলে বিক্রি না করে সব মিষ্টি ফেলে দিতে দেখেছেন বলেও জানালেন তিনি।

মানুষের আস্থায় মাতৃভান্ডার


সারাবছরই ভীড় লেগে থাকে মাতৃভান্ডারের ছোট্ট দোকানটায়। কুমিল্লার ক্রেতা তো আছেই, দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিনই এই দোকানে রসমালাইয়ের স্বাদ নিতে আসেন মিষ্টিপ্রিয় মানুষ। কুমিল্লার মানুষ আত্মীয়ের বাড়িতে গেলেই এখানকার রসমালাই নিয়ে যান। অতিথি আপ্যায়নে ক্রমেই এই অঞ্চলের মানুষের আস্হার নাম হয়ে ওঠেছে মাতৃভান্ডার।

ক্রেতারা বলছেন, এই দোকানের রসমালাইয়ের খ্যাতি ছড়িয়েছে এর অসাধারণ স্বাদের গুণে। বর্তমানে প্রতি কেজি রসমালাই বিক্রি হচ্ছে ২৬০ টাকায়। রসমালাই ছাড়াও মাতৃভান্ডারে বিভিন্ন রকমের মিষ্টি, ক্ষীর, ছানা মুড়কি বিক্রি হয়। 
স্বাদ আর গুণে মাতৃভান্ডার তার ঐতিহ্য ধরে রাখুক সামনের দিনগুলোতেও।


tags: কুমিল্লার রসমালাই কেন বিখ্যাত,কুমিল্লার রসমালাই এর ইতিহাস,আসল মাতৃভান্ডারের সন্ধানে,কুমিল্লা মাতৃভান্ডার রসমালাই, মাতৃভান্ডার রসমালাই দাম, comilla matri vandar, tma, tmabd,