Written by : Tanvir Mahatab Abir
ফাইন্যান্স বিভাগের প্রধান হিসেবে চাকরি করতেন শেল অয়েল কোম্পানিতে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর একাত্তরের মে মাসে চলে যান লন্ডনে। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য গড়ে তোলেন দুটি সংগঠন। সে বছরেরই ডিসেম্বরে সদ্যস্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ফেরার সময় তিনি তাঁর লন্ডনের ফ্ল্যাটটি ১৬,০০০ পাউন্ড দামে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। কী করেছিলেন তিনি এই টাকা? কীভাবে তাঁর হাত ধরে বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংস্থা হয়ে উঠেছে বাংলাদেশেরই একটি প্রতিষ্ঠান? চলুন গল্পটা জানার চেষ্টা করি এই লেখায়।
১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন ঐ অঞ্চলের জমিদার। ১৯৫৮ সালে লন্ডনে যখন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিংয়ে পড়েন, তখন তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। বছর চারেক পর এই কোর্স সম্পন্ন করে লন্ডনেই প্রথম চাকরিতে যোগ দেন তিনি। এরপর কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র হয়ে শেষমেশ থিতু হন দেশেই। যোগ দেন শেল অয়েল তেল কোম্পানিতে।
![]() |
তরুণ আবেদ |
১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এ সময় তিনি তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে ‘হেলপ’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তুলে ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত ভোলার মনপুরা দ্বীপের অধিবাসীদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। সেখানে তাঁরা ব্যাপক ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সেখানে তারা ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে রিলিফ দেয়া, ঘরবাড়ি তৈরি করে দেয়ার কাজ করেন। মনপুরার মানুষের দুর্দশা দেখে তাঁর মনে বড় পরিবর্তন আসে। মানুষের জন্য বড় পরিসরে কিছু করার ভাবনা আসে তাঁর মনে৷ একাত্তরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি লন্ডনে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য গড়ে তোলেন দুইটি সংগঠন। একাত্তরের ডিসেম্বরে তিনি সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ভিডিওর শুরুতেই আপনাদের জানিয়েছিলাম, লন্ডন থেকে ফেরার সময় তিনি তাঁর সেখানে থাকা ফ্ল্যাটটি ১৬,০০০ পাউন্ড দামে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। সেই অর্থ দিয়েই যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি, শুরু করেন ত্রাণ কার্যক্রম।
সিলেটের শাল্লায় যুদ্ধে বিধ্বস্ত একটি জনপদের মানুষজনের জন্য ত্রাণ সহায়তা দিতে গিয়ে রাতদিন খেটেছেন মানুষের জন্য। একটি দোচালা ঘরে হারিকেনের আলোতে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে গেছেন। যারা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে না - যাদের মধ্যে মেয়ে-শিশু বেশি - তাদের গাছতলায় বসে পড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন। এভাবেই প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিটি বা ব্র্যাকের। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন কার কথা বলছি। তিনি স্যার ফজলে হাসান আবেদ। বাংলাদেশ তো বটেই, এমনকি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন এবং দারিদ্র বিমোচনে কাজ করে এই এনজিওটি।
![]() |
মানুষের জন্য নিরন্তর কাজ করে গেছেন |
ত্রাণ সহায়তা এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়ে ফিরে আসি। যুদ্ধ পরবর্তী সময়টায় ভারত থেকে অনেক পরিবার ফেরত আসছিল। একদিন ফজলে হাসান আবেদ ভাবছিলেন, এই যে মানুষ দেশে আসছে, কিন্তু যুদ্ধে তো তাদের সমস্ত কিছু হারিয়ে গেছে। তিনি তখন তাদের উন্নয়নে কাজ শুরু করলেন। সেই যে শুরু করলেন, আর পিছু ফেরা হলো না। সেই সময় যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের অনেক কাজ ছিল। সরকারের পাশাপাশি তখন ব্র্যাকের মতো আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উন্নয়নমূলক কাজে এগিয়ে আসে।
আরও পড়ুন: রাসূলের মেরাজের রাতে যা ঘটেছিল
বাড়ি বিক্রি আর জমানো অর্থ দিয়ে কাজ শুরু করলেও, এরপরে বিদেশি দাতা সংস্থা অক্সফাম-জিবির সহায়তা পায় ব্র্যাক। ১৯৭২ সালের দিকে অক্সফাম-জিবি প্রায় দুই লক্ষ পাউন্ড দিয়েছিল। সেই অর্থ দিয়ে ব্র্যাক অনেকগুলো প্রকল্প নেয়। পরবর্তীতে আরো কিছু বিদেশি সংস্থার সহায়তা পায় স্যার আবেদের প্রতিষ্ঠান।
১৯৭৩ সালে যখন পুরোদস্তুর উন্নয়ন সংস্থা হিসাবে ব্র্যাক কার্যক্রম শুরু করে, তখন তার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় 'বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি।' তবে সংক্ষিপ্ত নাম ব্র্যাকই থেকে যায়।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, কবি সুফিয়া কামাল ছিলেন ব্র্যাকের প্রথম চেয়ারম্যান। একই সময়ে নির্বাহী পরিচালক হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ফজলে হাসান আবেদ। পরবর্তীতে ২০০১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন ফজলে হাসান আবেদ।
![]() |
বিল ও মেলিন্ডা গেটস এর সাথে স্যার আবেদ |
১৯৭৪ সালের দিকে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম শুরু করে ব্র্যাক। ক্ষুদ্র ঋণের বড় সুবিধা হলো, নিম্নবিত্ত মানুষদের কিছু করার জন্য, স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার জন্য পুঁজি পাওয়া যায়।
ব্র্যাক প্রথম দিকে দুইটি কার্যক্রম গুরুত্বের সঙ্গে শুরু করলো। একটি হচ্ছে বয়স্কদের শিক্ষার পাশাপাশি গ্রামে শিশু-তরুণদের শিক্ষা দেয়ার কার্যক্রম শুরু করা। দ্বিতীয়ত, নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা।
আশির দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় একটা অংশই আসতো বিদেশি ঋণ বা অনুদান থেকে। সে সময় ব্র্যাক চিন্তা করতে শুরু করলো, আমরা বিদেশি টাকার ওপর নির্ভর করে সারাজীবন চলতে পারবো না। তখন প্রতিষ্ঠানটি মানুষকে স্বনির্ভরশীল হয়ে ওঠতে বা তৈরি করতে উদ্যোগ নিলো।
![]() |
নাইট উপাধি গ্রহণের সময় |
ব্র্যাক ঋণ দিচ্ছে, মানুষ উৎপাদন করছে, কিন্তু সেটার বাজারজাত করতে পারছে না। মেয়েরা কাপড় তৈরি করছে, কিন্তু বিক্রি করতে পারছে না। আবার কৃষকরা বিক্রি যাদের কাছে করছে সেই আড়তদাররাই বা সেই পণ্য রাখবে কোথায়?
তখন ব্র্যাক কোল্ড স্টোরেজ করলো। ঋণ নিয়ে মানুষ গরু কিনে দুধ বিক্রি করতে পারছে না। ব্র্যাক দুধ কিনে নিচ্ছে, সেটার জন্য চিলিং সেন্টার করতে হচ্ছে। নারীদের তৈরি পণ্য বিক্রি করার জন্য তারা আউটলেট তৈরি করলো।
আরও পড়ুন: ফেসবুক প্রোফাইলে Warning পেলে কী করবেন?
মানুষকে শুধু সক্ষম করলেই চলবে না, তাকে আত্মনির্ভরশীল করতে হলে নিয়মিত রুজির ব্যবস্থা করতে হবে। বাজারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক করতে হবে। ব্র্যাকের এমন সম্মিলিত পদক্ষেপে সে সময় গ্রাম থেকে শহরব্যাপী সুফল পেতে শুরু করে মানুষ। প্রতিষ্ঠানটির এগিয়ে যাওয়ায় যেটি রেখেছে বড় ভূমিকা।
একসময় ক্ষুদ্র ঋণ ও নানা উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে ব্র্যাক কাজ করলেও ধীরে ধীরে তাদের নানা সহযোগী প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়।
১৯৭৮ সালে জন্ম হয় ব্র্যাকের অন্যতম ব্যবসাসফল সহযোগী প্রতিষ্ঠান আড়ং, যেখানে তৃণমূল নারীদের হাতে তৈরি নানা পণ্য বিক্রি হয়।
পর্যায়ক্রমে কোল্ড স্টোরেজ, পাস্তুরিকৃত দুধ ও দুগ্ধজাতীয় পণ্যের ব্যবসা, বিনিয়োগ, ও ব্যাংক এবং বিশ্ববিদ্যালয় সহ নানামুখী উদ্যোগে সম্প্রসারিত হয়েছে ব্র্যাক৷
ব্র্যাক যে শুধু দেশের মধ্যেই তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছে এমন নয়। ব্র্যাককে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে যাবার কথা ফজলে হাসান আবেদ প্রথম ভাবেন ২০০০ সালের দিকে। সে সময় তিনি একবার ক্যালিফোর্নিয়া গিয়েছিলেন, অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসের সঙ্গে ডিনারের সময় জবস তাকে বলেছিলেন, তোমার মডেলটা এত ভালো, তুমি বাংলাদেশের বাইরে কেনও কাজ করছো না? সেবারউ প্রথম স্যার আবেদ ভাবলেন যে দেশের বাইরে কাজ করা দরকার।
এর বছর দুয়েক পর জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থার তৎকালীন প্রধান আফগানিস্তানে ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্যে তাদের কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিকগুলোর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য পৃথিবীর সব দেশের প্রতিনিধিদের অনুরোধ জানিয়েছিলেন, সে সময় আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের কেউ সাড়া দেননি। শুধু স্যার ফজলে হাসান আবেদ হাত তুলে বলেছিলেন, আমি যেতে পারি।
সে বছরই আফগানিস্তানে কাজ করার মাধ্যমে দেশের বাইরে কর্মকাণ্ড শুরু হয় ব্র্যাকের।
বাংলাদেশ ছাড়াও বর্তমানে ব্র্যাকের কার্যক্রম বিস্তৃত রয়েছে মায়ানমার, নেপাল, রুয়ান্ডা, হাইতি, উগান্ডা, তানজানিয়া, লাইবেরিয়া, দক্ষিণ সুদান, সিয়েরা লিওন, আফগানিস্তান ও ফিলিপাইনে।
২০১৯ সালের তথ্য বলছে, বর্তমানে বিশ্বের ১২টি দেশে ব্র্যাকের কার্যক্রম রয়েছে। এসব দেশে প্রতিষ্ঠানটির নানান উদ্যোগ থেক ১১ কোটি ৩০লাখ মানুষ সেবা পাচ্ছে। ব্র্যাকের কর্মী সংখ্যা প্রায় ৯১ হাজার।
প্রতিষ্ঠানটি আশা করছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৫ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে তারা।
লেখাটি শেয়ার করে অন্যদেরও জানার সুযোগ করে দিন।
ট্যাগ : ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা, ফজলে হাসান আবেদ নাইট উপাধি, ফজলে হাসান আবেদ পরিবার, ফজলে হাসান আবেদ, ব্র্যাকের ইতিহাস, ফজলে হাসান আবেদ জীবনী,