সূরা কাহফ জুমার দিনে তেলাওয়াত গুরুত্বপূর্ণ কেন? | Surah Al-Kahf | TmA

 



সূরা কাহফ জুমার দিনে তেলাওয়াত গুরুত্বপূর্ণ কেন? | Surah Al-Kahf | TmA 


Written by : Tanvir Mahatab Abir

শুক্রবার আসলেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় সূরা কাহফ নিয়ে প্রচুর পোস্ট আসতে দেখা যায়, খেয়াল করেছেন? নিয়মিত এ সূরা তেলাওয়াতের ফজিলত সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। বিশেষ করে জুমার দিন এ সূরা তেলাওয়াতের ফজিলত অনেক বেশি। মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনের এই সূরাটি ঘিরে সপ্তাহের একটি দিন কেন এত আলোচনা হয়? কেন-ই বা এত ফজিলতের কথা বলা হয়েছে এই সূরা তেলাওয়াতে? এই লেখায় জানার চেষ্টা করবো সেটাই। 


 


কোরআনে সূরা কাহফ   


পবিত্র কোরআনে সূরা কাহফ অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ একটি সূরা। মক্কায় অবতীর্ণ হওয়া সূরাটির আয়াত সংখ্যা ১১০, রুকু ১২। এটি ১৫ নম্বর পারার দ্বিতীয় সূরা। কোরআন শরিফের ১৮ নম্বর সূরা সূরা কাহফ।


নামকরণে সূরা কাহফ 


কাহফ অর্থ গুহা। আসহাবে কাহফ মানে গুহাবাসী। এ সূরায় ওই সব মুমিন যুবক যারা দ্বীনকে সংরক্ষণের জন্য নিজেদের কোনো এক পাহাড়ের একটি গুহায় আত্মগোপনে রেখেছিলেন। তাদের ঘটনা বর্ণিত হওয়ায় এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে সূরা কাহফ।


কোন প্রেক্ষাপটে কাহফ নাযিল হয়েছিল? 


এ সূরা সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তাওরাত ও ইনজিলের আলেমরা রাসূল (সাঃ) এর নবুওয়াত সম্পর্কে কী বলে তা জানার জন্য মক্কার লোকেরা দু’জন লোককে মদিনার ইহুদিদের কাছে পাঠায়। ইহুদি আলেমরা তাদের বলল


আপনারা আপনাদের নবীকে তিনটি প্রশ্ন করবেন।


যদি এই প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে পারেন তাহলে তিনি সত্য নবী, আর উত্তর দিতে না পারলে তার নবুওয়াত সঠিক নয়। 


প্রশ্নগুলো হলো-


১. এক যুগে কিছু যুবক শিরক থেকে মুক্তিলাভের জন্য জন্মভূমি ত্যাগ করে একটি পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে ছিল, তাদের ঘটনা বলুন।


২. ওই ব্যক্তির কথা বলুন যিনি পূর্ব ও পশ্চিম পৃথিবী ভ্রমণ করেছিলেন।


৩. রুহের স্বরূপ কী?


ইহুদিদের প্রথমোক্ত দুই প্রশ্নের উত্তরে এ সূরাটি নাযিল হয়েছে। এতে গুহায় আত্মগোপনকারী যুবকদের ঘটনা সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। 





কী আছে সূরা কাহফে? 


এ সূরায় আল্লাহ তা’আলা অতীতের চারটি উল্লেখযোগ্য সত্য ঘটনা উল্লেখ করেছেন আমাদের শিক্ষাগ্রহণের জন্য।   


১. গুহাবাসীদের বিশ্বাসের ঘটনা


কয়েকজন যুবক আল্লাহর তায়ালার প্রতি পূর্ণ ঈমান আনার পর তাদের ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। তারা যখন একটি গুহার নিকট পৌঁছালেন, আল্লাহ তাদের সবাইকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ঘুম পাড়িয়ে দিলেন।


যখন তারা জেগে উঠলো, পরস্পর বলাবলি করছিল যে তারা হয়ত একদিন কিংবা অর্ধ দিন ঘুমিয়েছে। তাদের একজনকে যখন খাবার ক্রয়ের জন্য শহরে পাঠানো হল সে ভেবেছিল লোকেরা হয়ত তাকে চিনে ফেলবে এবং তার ক্ষতি করবে। কিন্তু সে তাদের মাঝে একজন অপরিচিত আগন্তুক হিসেবেই নিজেকে খুঁজে পেল। শহরের লোকেরা তাকে এবং তার ব্যবহৃত পুরাতন মুদ্রা দেখে বিস্মিত হল।


মূলত এ ঘটনাতে দেখানো হয়েছে, আল্লাহ তার উপর ভরসাকারী বান্দাদেরকে কী করে চরম প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করেন। এটা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে, আল্লাহ তায়ালার ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস আমাদের সবসময় হেফাজত করে থাকে।


২. দুই বাগানের মালিকের সম্পদের গল্প


গল্পটি এমন এক ব্যক্তির যার দুটি সুন্দর বাগান ছিল, কিন্তু এ কারণে সে অহংকারী হয়ে তার বন্ধুকে বলেছিল “আমি তোমার থেকে উত্তম কেননা তোমার থেকে আমার বেশি সম্পদ, কর্মচারী ও সন্তান রয়েছে। (১৮ঃ৩৪)


 লোকটি অহংকার বশত আল্লাহর নিয়ামতের কথা ভুলে গিয়েছিল। ফলে আল্লাহ তার বাগানগুলোকে ধ্বংস করে দিলেন। এখানে দেখা যায়, আল্লাহ সেই দুই বন্ধুর একজনকে এমন দুটি বাগান দিয়েছিলেন যেগুলো ছিল খেজুর গাছ দিয়ে পরিবেষ্টিত, সর্বদা ফলদানকারী, দুয়ের মাঝে ছিল শস্যক্ষেত্র আর জলাশয়।



অর্থাৎ সবদিক দিয়েই এই বাগান দুটি ছিল একজন কৃষকের জন্য স্বপ্নতুল্য। এই বিরাট নিয়ামত পেয়ে অহংকারী বন্ধুটি নিজেকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ভাবতে শুরু করল। প্রথমে সে দাবী করল এই দুনিয়ার সম্পদ অবিনশ্বর, এরপর সরাসরি পরকালকেই অস্বীকার করে বসলো। 


গল্পটি তাদের জন্য যারা দুনিয়ার মোহে পড়ে থাকে আর আল্লাহর নিয়ামতের কথা ভুলে যায়। তারা ভুলে যায় আল্লাহ ইচ্ছা করলেই তাদের কাছ থেকে সব কিছু কেড়ে নিতে পারেন।



৩. মুসা ও খিজির আলাইহি ওয়া সাল্লামের জ্ঞানের গল্প


রাসুল (সাঃ) বলেছেন, একবার মুসা (আঃ) বনি ইসরাইলিদের সামনে ভাষণ দিচ্ছিলেন। একজন তার কাছে জানতে চাইল, মানুষের মাঝে সবচেয়ে জ্ঞানী কে? তিনি জবাব দিলেন আমি। আল্লাহ মুসা (আঃ)কে জানিয়ে দিলেন তিনি (আল্লাহ) তাকে সকল জ্ঞানের অধীকারী বানান নি। আল্লাহ তাকে বললেন, “দুই সাগরের সংযোগস্থলে আমার এক বান্দা আছে যে তোমার চাইতেও অধিক জ্ঞানী।


মুসা (আঃ) আরজ করলেন হে আল্লাহ! আমি তার দেখা কী করে পাব? আল্লাহ মুসা (আঃ) কে সে মানুষটিকে খুঁজে পাওয়ার উপায় বলে দিলেন যিনি খিজির (চির সবুজ) নামে পরিচিত ছিলেন।



হজরত মুসা (আঃ) খিজির (আঃ) এর সাথে সফর করলেন এবং বুঝতে পারলেন আল্লাহ যাকে খুশি তাকেই জ্ঞান দান করেন। যেহেতু সকল জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ, তাই কারো জ্ঞান নিয়ে অহংকার করা উচিৎ নয়। খিজির (আঃ) নিজেও বলেছেন, আমি আমার ইচ্ছায় কিছুই করিনি। 


৪. ন্যায়পরায়ণ বাদশা যুলকারনাইনের ক্ষমতার গল্প


যুলকারনাইন ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ ও সৎ বাদশাহ, তিনি পশ্চিম থেকে পূর্ব পর্যন্ত সফর করেছিলেন। এ সফরের কথা কোরআনেও উল্লেখ করা হয়েছে। তার শেষ সফরে তিনি দুই পর্বতের মাঝে এক জনগোষ্ঠীকে খুঁজে পেলেন। তারা তার কাছে ইয়াজুজ ও মাজুজের হাত থেকে রক্ষা পেতে একটি দেওয়াল নির্মাণের আবেদন জানালো। যুলকারনাইন কাজটি করে দিতে সম্মত হলেন।



যুলকারনাইন তার কাজ নিয়ে গর্ব করেন নি। দেওয়াল নির্মানের পর তার দেওয়া ভাষণ কোরআনে এসেছে, সে (যুলকারনাইন) বলল, এগুলো আমার মালিকের অনুগ্রহ, কিন্তু যখন আমার মালিকের নির্ধারিত সময় আসবে, তিনি এগুলো চূর্ণ বিচূর্ণ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিবেন, আর আমার প্রভুর ওয়াদাই চূড়ান্ত সত্য। (১৮:৯৮)


সূরা কাহফ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?  


হজরত আনাস (রা.) বর্ণিত, এ পুর্ণাঙ্গ সূরাটি এক সঙ্গে নাযিল হয়েছে এবং এর সঙ্গে ৭০ হাজার ফেরেশতা দুনিয়াতে আগমন করেছেন।


হযরত বারা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাতে সূরা কাহফ তেলাওয়াত করছিলেন। তার কাছে দুটি রশি দিয়ে একটি ঘোড়া বাঁধা ছিল। এরই মধ্যে একটি মেঘখণ্ড এসে তাকে ঢেকে ফেলল। এরপর যখন মেঘখণ্ডটি তার কাছে চলে আসছিল, তখন তার ঘোড়া ছোটাছুটি করতে লাগল। অতঃপর সকালে ওই ব্যক্তি রাসূল (সাঃ) এর কাছে এসে রাতের ঘটনা বললেন। তিনি বললেন, ওটা ছিল সাকিনা (রহমত), যা কোরআন তেলাওয়াতের বরকতে নাযিল হয়েছিল। (সহিহ বোখারি: ৫০১১, ৩৬১৪; সহিহ মুসলিম: ৭৯৫ ) 




হযরত নাওয়াস ইবনে সাময়ান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) একদিন সকালে দাজ্জালের কথা আলোচনা করলেন। তিনি আওয়াজকে উঁচু-নিচু করছিলেন, ফলে আমরা মনে করলাম দাজ্জাল খেজুর বাগানের মধ্যেই রয়েছে। অতঃপর যখন আমরা উনার কাছে গেলাম তখন তিনি আমাদের অবস্থা বুঝে ফেললেন। তিনি বললেন, তোমাদের কী হলো। আমরা বললাম, আল্লাহর রাসূল! আপনি সকালে দাজ্জালের কথা আলোচনা করেছিলেন, আওয়াজকে উঁচু-নিচু করেছিলেন- তাই আমরা মনে করলাম দাজ্জাল হয়তো খেজুর বাগানেই আছে। তিনি বললেন, তোমাদের ক্ষেত্রে দাজ্জাল ছাড়া অন্য কিছুতে এত বেশি ভয় আমাকে দেখানো হয়নি। যদি আমি তোমাদের মাঝে থাকা অবস্থায় সে বের হয়, তাহলে তোমাদের ছাড়া আমি সর্বপ্রথম তার প্রতিরোধ করব। আর যদি তোমাদের মাঝে না থাকা অবস্থায় সে বের হয়, তাহলে প্রত্যেকে তার প্রতিরোধ করবে। আল্লাহর শপথ! প্রত্যেক মুসলমানের ওপর আমার খলিফা রয়েছে। নিশ্চয় দাজ্জাল কোঁকড়া চুলবিশিষ্ট যুবক হবে এবং তার চোখ কানা হবে। যেন আমি আবদুল ওযা ইবনে কাতালের মতো তাকে দেখতে পাচ্ছি। তোমাদের মধ্যে যে তাকে পাবে সে যেন সূরা কাহফের শুরু অংশ পড়ে। (সহিহ মুসলিম: ২৯৩৭, সুনানে আবু দাউদ: ৪৩২১, তিরমিজি: ২২৪১)



সূরা কাহফ নিয়ে কী বলা হয়েছে হাদিসে? 


আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেন, যেমনভাবে নাযিল করা হয়েছে, সেভাবে যে ব্যক্তি সূরা কাহফ পড়বে, তার জন্য সেটা নিজের স্থান থেকে মক্কা পর্যন্ত আলো হবে এবং যে শেষ দশ আয়াত পড়বে, সে দাজ্জালের গণ্ডির বাইরে থাকবে এবং দাজ্জাল তার ওপর কোনোরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। (সুনানে নাসাঈ, হাদিস নং : ১০৭২২) 


হজরত আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, যে ব্যক্তি সূরা কাহাফ যেমনভাবে নাযিল হয়েছে সেভাবে পড়বে, তার জন্য কেয়ামতের দিন সেটা নূর হবে। (শোয়াবুল ঈমান: ২২২১ ) 


মুসনাদে আহমদে হযরত সাহল ইবনে মুয়াজের রেওয়াতে আছে যে, রাসূল (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি সূরা কাহফের প্রথম ও শেষ আয়াতগুলো পাঠ করে তার জন্য তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটি নূর হয়ে যায়। আর যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ সূরা পাঠ করে তার জন্য জমিন থেকে আসমান পর্যন্ত নূর হয়ে যায়।



শুক্রবারেই কেন সূরা কাহফ তেলাওয়াত করতে হবে? 


হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) রাসূল ঃ) থেকে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করবে তার জন্য এক জুমা থেকে অপর জুমা পর্যন্ত নূর হবে।


আরেক হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন সূরা কাহাফ পাঠ করবে সে আট দিন পর্যন্ত সব ধরনের ফেতনা থেকে নিরাপদ থাকবে। যদি দাজ্জাল বের হয় তবে তার ফেতনা থেকেও নিরাপদ থাকবে। 



জুমার দিনে সূরা কাহফ পাঠ করলে কিয়ামত দিবসে তার পায়ের নিচ থেকে আকাশের মেঘমালা পর্যন্ত নূর আলোকিত হবে এবং দুই জুমার মধ্যবর্তী গুনাহ মাফ হবে। (আত তারগিব ওয়াল তারহিব-১/২৯৮)। 


যে ব্যক্তি জুমার দিন সূরা আল কাহফ পড়বে, তার (ঈমানের) নূর এ জুমা হতে আগামী জুমা পর্যন্ত চমকাতে থাকবে। (মিশকাত ২১৭৫)। 


 


সূরা কাহফ পড়ার সময় কখন? 


বৃহস্পত পর থেকে শুক্রবার সূর্য ডোবা পর্যন্ত যে কোনো সময় সূরা কাহফ পাঠ করলে হাদিস অনুযায়ী আমল করার কথা বলা হয়েছে বিভিন্ন সূত্রে। 


তবে এক বৈঠকে সম্পূর্ণ সূরা পড়া জরুরি নয়। বরং বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে শুরু করে শুক্রবার সূর্যাস্ত পর্যন্ত একাধিক বৈঠকে ভাগ ভাগ করে উক্ত সূরা পড়ে শেষ করলেও একই সওয়াব পাওয়া যাবে।


সূরা কাহফ কোরআনুল কারিমের অন্যতম ঘটনাবহুল সূরা। এই সূরা তেলাওয়াতের পাশাপাশি অর্থের দিকে খেয়াল করলেও অনেক শিক্ষা অর্জন হয়। প্রতি সপ্তাহে একবার তেলাওয়াত করলে, বছরে বায়ান্নবার। এর শিক্ষণীয় ঘটনাগুলো একেকটি বছরে বায়ান্নবার চিন্তায় ঘুরপাক খাওয়া মানে, নিজের মধ্যে বিরাট সংশোধনী চলে আসা। 


tags: Surah Al-Kahf, tma,tmabd,Surah kahf bangla,Surah kahf bangla pdf,সূরা কাহাফ অডিও,সূরা কাহাফ pdf,জুমার দিনে 'সূরা কাহাফ' তেলাওয়াতের ফজিলত, সূরা আল কাহাফ,পবিত্র কুরআনের ১৮নং সূরা, শুক্রবারের বিশেষ আমল,সূরা কাহাফ পাঠের ফজিলত, জুমার দিন সূরা কাহাফ গুণাহ মাফ করে,সূরা কাহাফ বাংলা উচ্চারণ,