আরবি ক্যালেন্ডারে ১২ই রবিউল আওয়াল পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী হিসেবে পালন করা হয়। এ বছর ২০ অক্টোবর বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে ঈদে মিলাদুন্নবী।
ঈদে মিলাদুন্নবী কী?
আরবি ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’র অর্থ- ইসলামের সর্বশেষ নবী রাসূলে কারীম (সা.) জন্মদিনের আনন্দোৎসব। মুসলমানরা ১২ রবিউল আউয়াল মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.) এর জন্ম ও মৃত্যু (ওফাত) দিবস হিসেবে পালন করে। কারণ এ দিনেই তিনি ইন্তেকালও করেন।
৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের হিজরি রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ মক্কার কুরাইশ বংশে মুহম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬৩ বছর বয়সে ১২ রবিউল আউয়ালেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
দিনটি ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) হিসেবে পৃথিবীর মুসলমানরা পালন করে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঈদে মিলাদুন্নবীর (সা.) দিন সাধারণ ছুটি পালিত হয়।
ইসলামের প্রথমদিকে ছিল না মিলাদুন্নবী?
হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর প্রথম যুগে সাহাবী, তাবেয়ি ও তাবে তাবেয়িদের মধ্যে রাসূল (সা.)-এর জন্মদিন পালন বা উদযাপন করার প্রচলন ছিল না। মুহাদ্দিস, ফিকহ ও ঐতিহাসিকদের গবেষণায় এসেছে এমন তথ্য।
রাসূল (সা.) জন্মদিন পালন বা রবিউল আউয়াল মাসে ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের বৈধতা ও অবৈধতা নিয়ে খোদ আলেম সমাজেই মতবিরোধ দেখা যায়। তবে সকলেই একমত যে, ইসলামের প্রথম শতাব্দীগুলোতে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন রীতি ছিল না।
দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীতে সংকলিত অর্ধশতাধিক সনদভিত্তিক হাদিসের গ্রন্থে রাসূল (সা.)-এর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কর্ম, আচার-আচরণ, কথা, অনুমোদন, আকৃতি, প্রকৃতি ইত্যাদি সংকলিত হয়েছে। সংকলিত হয়েছে সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়িদের মতামত ও কর্ম। সেসব গ্রন্থ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় বা তাঁর মৃত্যুর পর কোনো সাহাবী সামাজিকভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে তাঁর জন্ম উদযাপন, জন্মদিন নিয়ে আলোচনা বা জন্ম উপলক্ষে আনন্দ প্রকাশের জন্য নির্দিষ্ট কোনো দিন বা অনির্দিষ্টভাবে বছরের কোনো সময়ে কোনো অনুষ্ঠান করেন নি। এমন কোনো রীতিই ছিল না সে সময়।
তাহলে প্রথম উদ্ভাবক কে?
ঈদে মিলাদুন্নবীর প্রবর্তক হিসেবে সর্বাধিক উচ্চারিত নাম ইরাকে ইরবিল প্রদেশের শাসক আবু সাঈদ কুকুবুরি। তিনিই প্রথম সুন্নিসহ বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঈদে মিলাদুন্নবীর প্রবর্তন করেন। সিরাতুন্নবী গবেষক ও ঐতিহাসিকরা তাকেই মিলাদুন্নবীর প্রকৃত উদ্ভাবক বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ তিনিই প্রথম এই উৎসবকে বৃহৎ আকারে উদযাপন শুরু করেন । কুকুবরি ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত। পিতার মৃত্যুর পর মাত্র ১৪ বছর বয়সে কুকুবুরি ইরবিলের শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনি অল্প বয়স্ক হওয়ার কারণে তার অভিভাবক হিসেবে নিযুক্ত হন আতাবিক মুজাহিদ উদ্দিন কায়মায।
আরো পড়ুন : ১. স্বপ্নে কী এমন ভয়ংকর ব্যাপার দেখেছিলেন রাসূল (সাঃ)?
ছোট রাজ্যের রাজা হলেও কুকুবুরি প্রতি বছর ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতেন।
ঈদে মিলাদুন্নবী প্রচলনের ক্ষেত্রে আরও একজনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা জানা যায়। তিনি হলেন, মিলাদুন্নবী বিষয়ে লেখা সর্বপ্রথম গ্রন্থ প্রণেতা আল্লামা আবুল খাত্তাব ওমর আবনে হাসান ইবনে দেহিয়া আল কালবি। ঈদে মিলাদুন্নবী বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করার জন্য কুকুবুরি তাকে ১ হাজার স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করেছিলেন। ৯০ বছরের দীর্ঘ জীবনে তিনি ইসলামি বিশ্বের সর্বত্র ভ্রমণ করেন এবং ঈদে মিলাদুন্নবী নিয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি করেন।
ইতিহাস কী বলছে?
নবী (সা.) এর সময়, খোলাফায়ে রাশিদিনের সময় এবং উমাইয়া খলিফাদের সময়ে ঈদে মিলাদুন্নবী উৎসব ছিল না। মদীনা শরীফে নবী (সা.) এর রওজা মোবারক জিয়ারত করার ও সেখানে দরূদ ও দু’আ পাঠ করার ব্যবস্থা রয়েছে। এই ব্যবস্থার অনুকরণে রাসূল (সা.) মক্কায় যে ঘরে ভূমিষ্ট হয়েছিলেন, সেই ঘরটির জিয়ারত ও সেখানে দু’আ করার প্রথা সর্ব প্রথম আব্বাসীয় খলিফাদের যুগে বাদশা হারুনুর রশীদের মাতা খায়জুরান বিবি চালু করেন।
পরবর্তী কালে ১২ রবিউল আওয়ালে ঐ নারীর নেতৃত্বে র্তীথযাত্রীগণ প্রতি বছর নবী (সা.) এর জন্ম দিবস ধরে নিয়ে ঐ ঘরে আনন্দোৎসব পালন করেন। (ইবনে জারীর- ১১৪-১১৫পৃঃ)
মিসরে ফাতেমী শিয়া শাসকরা মুসলিমদের মধ্যে জন্ম বার্ষিকী পালনের রীতি চালু করেন।
৫৬৭ হিজরিতে গাজী সালাউদ্দিন আইয়ুবির মিসর দখলের মধ্য দিয়ে ফাতেমি রাজত্বের পতন ঘটে। তবে, দুই শতাব্দীর শাসনামলে ফাতেমি রাজবংশের ইসমাঈলি শিয়া শাসকরা দুই ঈদ ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি দিবস পালন করতেন। এসব উৎসবের বেশিরভাগই ছিল জন্মদিন। এর মধ্যে রাসূল (সা.)-এর জন্মদিনও ছিল। এ উপলক্ষে বিপুল পরিমাণ উন্নত মানের মিষ্টান্ন তৈরি করা হতো।
ভারতীয় উপমহাদেশে মিলাদুন্নবী প্রচলনকারীরা ছিল শিয়া সম্প্রদায়। ইসলামের মধ্যে মিলাদ, মিলাদুন্নবী প্রচলনকারী হলেন ফাতেমীয় শাসক শিয়া মুয়ীযলি দীনিল্লাহ, আর ভারত উপমহাদেশে মিলাদ প্রচলনকারী হলেন মোঘাল সম্রাট হুমায়ুন ও সম্রাট আকবরের মাতা ও অভিবাবক বৈরাম খাঁ । এরা দু‘জনেই কট্টর শিয়া ছিলেন।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাষ্ট্রদূত, শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহও ছিলেন শিয়া। মোট কথা সম্রাটদের মাধ্যমে এই উপমহাদেশে সুন্নীদের মাঝে মিলাদুন্নবীর প্রচলন হয়। ফলে শিয়া মতাদর্শী মিলাদ ও মিলাদুন্নবীর আনুসাঙ্গিক ব্যাপারগুলো সুন্নিদের মধ্যে প্রচলিত হয়। (শাইখ আইনুল বারী, মিলাদুন্নবী ও বিভিন্ন বার্ষিক- ৩৩ পৃ)
দেশে দেশে ইদে মিলাদুন্নবী
বাংলাদেশ- বাংলাদেশে যথাযথ মর্যাদা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপযাপিত হয়। এ দিনটিকে সরকারি ছুটি হিসেবে গণ্য করা হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এ উপলক্ষে আলোচনা সভা, সেমিনার ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করে।সরকারিভাবে এ সময় রাস্তায় কালেমা খচিত পতাকা লাগানো হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভবনে রাতে আলোকসজ্জা করা হয়। মসজিদ, মাজার এবং বাড়ির অন্দর মহলেও চলে মিলাদ ও দরুদ পাঠের মহাযজ্ঞ।
ভারত - মিলাদুন্নবী (সা.) পালনের জন্য নির্ধারিত দিনের বেশ আগেই দেশটির মুসুল্লিগণ মসজিদে অবস্থান শুরু করেন এবং ক্রমাগত ইবাদত-বন্দেগি করতে থাকেন। অন্যদিকে আজমির শরিফ এবং দিল্লির নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজার প্রাঙ্গণে ও পার্শ্ববর্তী মসজিদে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে্য ব্যাপক ইবাদত-বন্দেগী চলতে থাকে।
পাকিস্তান- ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর এক মাস আগে থেকেই পাড়ামহল্লা ও রাস্তাঘাটে ছোট ছোট দোকান গড়ে ওঠে বিশেষ ধরনের ব্যাজ, সবুজ পতাকা, টুপি ও ব্যানারের পসরা নিয়ে। মিলাদুন্নবী (সা.) আগমন উপলক্ষে রাজধানী ইসলামাবাদে ৩১ বার এবং অন্যান্য রাজ্যের রাজধানীতে ২১ বার তোপধ্বনি বা কামানের গোলা বিকট শব্দে ফাটিয়ে মহানবী (সা.)-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয় এবং ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর আগমন ঘোষিত হয়। এ সময় দেশটির সরকারি ও বেসরকারি ভবনগুলোতে দিনে জাতীয় পতাকা ও রাতে রং-বেরঙের আলোকসজ্জা সবাইকে মুগ্ধ করে।
ইন্দোনেশিয়া - বর্তমানে জাকার্তাসহ ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে সাকাতেন বা ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে সাত দিনব্যাপী উৎসব হয়। এই উৎসবে স্থানীয় সংস্কৃতির মিশ্রণে মহানবী (সা.)-এর জীবনী আলোচনা হয় এবং অন্যান্য ইবাদত করা হয়। বিশেষত্ব ১২ রবিউল আওয়াল তারিখে বিভিন্ন মসজিদ ও বাসাবাড়িতে ব্যাপকভাবে নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতায় স্মরণ করা হয় ইসলামের প্রবক্তা মুহাম্মদ (সা.)-কে। এ উপলক্ষে সারা রাত মেলার আদলে রাস্তাঘাট ও বাজারে বেচাকেনা চলে। ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে বড় বড় ডেকচিতে নারিকেল, বাদাম, চিংড়ি ও মরিচের সংমিশ্রণে বিশেষ ধরনের ভাত রান্না করা হয়, যা স্থানীয়ভাবে সিগোগরিই নামে পরিচিত।
লিবিয়া- প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মদিন পালনে সুফি মতবাদে প্রচলিত আনুষ্ঠানিকতা অনুসরণ করে। রাজধানী ত্রিপোলিসহ লিবিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বিখ্যাত কিছু সুফি মতানুসারী নিয়ন্ত্রিত মসজিদ রয়েছে, যেখানে যথাযথ মর্যাদায় ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালিত হয়।
এই দিনে দেশটিতে ছুটি পালন করা হয় এবং প্রাচীন ঐতিহ্যে বিভিন্ন শহরের রাস্তায় শোভাযাত্রা বের করা হয়। এসব মিছিলে সমবেতভাবে ভক্তিমূলক গান ও নাতে রসুল (সা.)-এর মাধ্যমে মহানবী (সা.)-এর মাহাত্ম্য বন্দনা করা হয়। সেই সঙ্গে মিছিলে বিশেষ ধরনের ঢোল ও বড় মন্দিরা বা ট্রাম্পেট বাজান হয়। মিছিল বা শোভাযাত্রা শেষে রসুল (সা.)-এর ভক্তরা একটি স্থানে সমবেত হয় যেখানে একজন ধর্মীয় নেতা ইসলাম এবং রাসূল (সা.) এর আদর্শের বক্তব্য রাখেন।
tags: ঈদে মিলাদুন্নবী নামাজ,সকল ঈদের সেরা ঈদ,মিলাদুন্নবী (সা.),tma,tmabd,১২ রবিউল আউয়াল,ঈদে মিলাদুন্নবী কি ও কেন,ঈদে মিলাদুন্নবী সম্পর্কে হাদিস, ঈদে মিলাদুন্নবী কি বিদাত,ঈদে মিলাদুন্নবী ২০২১ কত তারিখ,