Written by : Tanvir Mahatab Abir
রাজধানীর খিলক্ষেতে স্বামী আর এক সন্তান নিয়ে ছোট্ট সংসার অরণীর। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে তার স্বামী যে চাকরি করতেন সেখানে করোনাকালে বেতন কমিয়ে অর্ধেক করে ফেলায় সমস্যায় পড়ে অরণীর সংসার। সাংসারিক ব্যয় মেটাতে লাখ দুয়েক টাকা ঋণ নিয়ে ছোট্ট মুদি দোকান চালু করেন অরণী। দোকান ভালো চললেও মাঝে মাঝে পণ্য সংকট দেখা দেয়। পণ্য আনতে গেলে দোকান বন্ধ রাখতে হয়। মাঝেমধ্যে অর্থের অভাবেও প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারেন না। পণ্য না পেয়ে ক্রেতাদের কেউ কেউ তার দোকানে আসাও বন্ধ করে দিয়েছেন। বছরখানেক আগে তার পাশে এসে দাঁড়ায় শপআপ। এই স্টার্টআপের মাধ্যমে যখন যে পণ্য লাগে, সেটি অনলাইনে ক্রয়াদেশ দিলেই দোকানে পৌঁছে যায়। অর্থের টান থাকলেও সমস্যা নেই। বাকিতেও পণ্য কেনা যায়। এমন করে ডিজিটাল বাংলাদেশের গল্পে সফলতার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠছেন অরণীদের মতো অসংখ্য উদ্যোক্তা।
ডিজিটাল বাংলাদেশ। মনে পড়ে প্রথম কবে এই শব্দটি শুনেছিলেন? ২০০৮ সালে ডিজিটাল সুবিধা চালু করে নাগরিকদের জীবন আরও সহজ ও সুন্দর করার লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরের ঘোষণা দেন। এই যে ডিজিটাল সুবিধার কথা বলা হচ্ছে, সেটি আসলে কী? অরণীর গল্পেই আছে সেই উত্তর। পণ্য কিনতে এখন আর নিজের দোকান বন্ধ করে বাজারে বাজারে ঘুরতে হয় না অরণীকে। ঘরে বসেই শপআপের মাধ্যমে মান ও দাম যাচাই করে পণ্য অর্ডার করতে পারেন তিনি। দিন পেরোনোর আগেই সেই পণ্য চলে আসে তার দোকানে। সারা দেশের ৮-৯ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার কাছে পৌঁছে গেছে শপআপ। এই স্টার্টআপ নতুন করে ৬৪০ কোটি টাকার বড় বিনিয়োগ পেয়েছে। গত অক্টোবরে ১৯০ কোটি টাকার ‘সিরিজ এ’ বিনিয়োগ পেয়েছিল শপআপ। এমন বেশ কিছু স্টার্টআপ এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এনালগ থেকে এভাবেই ডিজিটাল যুগে পা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ। সৃষ্টি করছে নিত্য নতুন সম্ভাবনা, বাড়ছে কাজের সুযোগও, হচ্ছে কর্মসংস্থান। ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রশ্নে আমরা আবার ফিরবো, তবে তার আগে দেশে চাকরির হালচাল নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করা যাক চলুন।
| ইভ্যালির বিজনেস মডেল কেমন?
২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ১৪ শতাংশ মানুষ। সরকারি কাজে যুক্ত রয়েছেন মাত্র ৩ শতাংশের মতো চাকুরিজীবী।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২৫ লাখ তরুণ নতুন করে শ্রমবাজারে প্রবেশ করে।
একটা সময় সরকারি চাকরির জন্য দিনরাত এক করে পড়াশোনা করতে দেখা যেত সিংহভাগ তরুণ-তরুণীদের। বেতন নিশ্চয়তা, পারিবারিক চাপ কিংবা সামাজিক অবস্থান এমন অনেক ফ্যাক্টরই সরকারি চাকরির দিকে ঝুঁকতে বাধ্য করতো তরুণদের। কিন্তু সময় বদলেছে, বদলেছে দৃষ্টিভঙ্গিও। তরুণরা এখন উৎসাহিত হচ্ছেন বেসরকারি চাকরিতে, নিজেরা উদ্যোক্তা হয়ে সুযোগ করে দিচ্ছেন কর্মসংস্থানেরও। কিন্তু প্রথাগত চাকরির বাজারের পরিধি সে তুলনায় না বাড়ায় বেকারত্বের হার কমানো দায় হয়ে উঠছে সরকারের জন্য। তার প্রতিফলন আছে পরিসংখ্যানেও। বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। এমন যখন অবস্থা, সে সময় ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে এসেছে নতুন সম্ভাবনা, খুলে দিয়েছে কর্মসংস্থানের দ্বার।
ধরুন, আপনার এই মুহূর্তে খুব চিকেন বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছে করছে। ঘরে এটি রান্নার সকল উপাদান নেই, দোকান থেকে আনিয়ে রান্না করার মতো সময়ও নেই। কী করবেন? আজ থেকে দশ বছর আগে হলে বলা যেতো ইচ্ছেটাকে পূরণের আশা বাদ দিতে। কিন্তু এখন আপনার ইচ্ছে পূরণ আপনার ফোনে কয়েকটি ক্লিকের ব্যাপার মাত্র। অনলাইন ফুড ডেলিভারি সার্ভিস বর্হিবিশ্বে অনেক আগে থেকেই প্রচলিত থাকলেও বাংলাদেশে এই উদ্যোগের শুরুটা ২০১৩ সালে, হাংরি নাকি'র হাত ধরে। দেশে বর্তমানে শতাধিক প্রতিষ্ঠান ফুড ডেলিভারির ব্যবসায় নিজেদের নাম লেখিয়েছে। এখন দিনে ফুড ডেলিভারি প্ল্যাটফর্মে অর্ডার আসছে প্রায় ১ থেকে সোয়া লাখ পর্যন্ত। যার অর্থমূল্য প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ কোটি টাকা। সেই হিসাবে বার্ষিক প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার দেশীয় বাজার রয়েছে এই খাতে। ঘরে বসেই খাবার অর্ডারের এই ব্যবসায় কর্মসংস্থানের পথও খুলে দিয়েছে অনেককেই। এডমিনিস্ট্রেশন, সাপ্লাই চেইন কিংবা ডেলিভারিতে অসংখ্য তরুণ এমনকি অবসরপ্রাপ্তরাও যুক্ত হচ্ছেন। এমনকি ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে হোমমেড ফুড ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন এই ডেলিভারি সার্ভিসগুলোর মাধ্যমেই।
এই ডেলিভারি সার্ভিসগুলো করোনাকালে সামাজিক দূরত্ব মানার প্রশ্নে ক্যাশ অন ডেলিভারির পাশাপাশি ক্যাশলেস অর্থাৎ অনলাইনেই পেমেন্ট সুবিধা চালু করে। অনলাইন পেমেন্টের ক্ষেত্রে বড় সমাধান হয়ে এসেছে বিকাশ, নগদ, উপায় কিংবা রকেটের মতো মানি ট্রান্সফার সিস্টেমগুলো। শুধু ক্যাশলেস পেমেন্টই নয়, শহর থেকে গ্রামে গেল এক দশকে বেশ জনপ্রিয় হতে দেখা গেছে মানি ট্রান্সফার সিস্টেমগুলো। বিকাশের কথাই ধরা যাক। বর্তমানে ১৫ ভাগেরও কম বাংলাদেশি প্রথাগত ব্যাংকিং পদ্ধতির আওতায় আছে, যেখানে ৬৮ ভাগেরও বেশি মানুষের কাছে মোবাইল ফোন রয়েছে। এই মোবাইল ফোনগুলো শুধু কথা বলার উপকরণই নয়, বরং আরও অনেক প্রয়োজনীয় এবং পরিশীলিত কার্যক্রমও পরিচালনা করতে সক্ষম। ২০১০ সালে যাত্রা শুরু করা বিকাশ প্রাথমিকভাবে এই মোবাইল ডিভাইসগুলো এবং বিস্তৃত টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্কের সঠিক ব্যবহার করে একটি নিরাপদ প্লাটফর্মের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রান্তিক ও বঞ্চিত মানুষের কাছে আর্থিক সেবাসমূহ পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। বর্তমানে, বিকাশের ৫ কোটি গ্রাহক রয়েছে। শুধু গ্রাহকসেবাই নয়, কর্মসংস্থানের অপার সম্ভাবনায়ও নিজেদের যুক্ত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশের শহুরে ও গ্রামাঞ্চলে বর্তমানে বিকাশের দুই লক্ষাধিক এজেন্ট নেটওয়ার্ক রয়েছে।
করোনার কারণে বহু প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করেছে। বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানও। বন্ধ ছিল বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষাও। এতে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। আবার চাকরি থাকলেও অনেকের বেতন কমেছে। দুটো মিলিয়ে দেশের বিপুল মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন। মহামারীতে বাংলাদেশে প্রতি চারজন যুবকের মধ্যে একজন কর্মহীন বা বেকার রয়েছে। এই অবস্থায় উপার্জনের বিকল্প পথ হিসেবে অন্যান্য পেশার সাথে বেছে নিতে দেখা যায় রাইড শেয়ারিং-কেও। বিশেষত করোনাকালে গণপরিবহন এড়িয়ে স্বল্প ব্যয়ে ব্যক্তিগত গাড়ির সুবিধা নিয়ে রাইড শেয়ারিং অ্যাপগুলো স্বস্তি এনেছে যাত্রীদের মধ্যে। পাশাপাশি বেকারত্ব দূরীকরণেও প্রভাব রাখছে প্রতিষ্ঠানগুলো। ঢাকার ফার্মগেটের আসাদুল ইসলাম আগে একটি বেসরকারি সংস্থার সেলসম্যান হিসাবে চাকরি করতেন। কিন্তু মোটরসাইকেলে যাত্রী বহনে আয় বেশি হওয়ায় সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে পূর্ণকালীন মোটরসাইকেল চালাতে শুরু করেছেন। ২০১৬ সালের শেষদিকে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের বৃহত্তম রাইড শেয়ারিং কোম্পানি পাঠাও জানিয়েছে, ২০১৯ সাল পর্যন্ত দুই বছরে ৪ কোটির বেশি ট্রিপ দিয়েছেন পাঠাওয়ের চালকরা৷ বাংলাদেশে অ্যাপ ভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা দুই হাজার ২০০ কোটি টাকার বাজার তৈরি করেছে।
করোনাকালে প্রযুক্তিগত সম্ভাবনায় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রেখেছে বাংলাদেশ। হালের ই-কমার্স এখন স্বাবলম্বী করে তুলছে শহর থেকে গ্রামের অসংখ্য বেকার মানুষকে। আপনাকে এখন কিছু কিনতে পাশের রুমটিতেও যেতে হবে না। ফেসবুকে যদি থাকে একটি একাউন্ট, তবেই সব পণ্য এখন আপনার হাতের মুঠোয়। এখন এমন কোনো জিনিস নেই যা আপনি অনলাইনে বা ফেসবুকে কিনতে পারবেন না। নতুন পাশ করা ছেলেমেয়েরা যারা চাকুরির জন্য চেষ্টা করছিলেন, মহামারীর কারণে পড়াশুনা বন্ধ হয়ে রয়েছে এমন ছেলেমেয়েরা, এমনকি যারা নানা পেশায় যুক্ত ছিলেন কিন্তু কাজ হারিয়েছেন বা বেতন কমে গেছে তারাও ই-কমার্সে যুক্ত হয়েছেন। গেল বছর ই-কমার্স খাতে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। গত বছর সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির সময় ডিজিটাল পদ্ধতিতে লেনদেন ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছিল। ডিজিটাল বাংলাদেশ ঠিক কতটা বদলে দিয়েছে চাকরি কিংবা আয়ের বাজার, তা এই গল্পগুলোতেই দৃশ্যমান।
ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা বাস্তবায়ন শুরুর পর গেল ১২ বছরে এ খাতে ১৫ লাখের বেশি কর্মসংস্থান হয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৫৬ লাখ থেকে ১২ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। এক যুগ আগে যেখানে সরকারি ওয়েবসাইট ছিল ৫০টিরও কম, সেখানে বর্তমানে সরকারি ওয়েবসাইট ৫১ হাজারেরও বেশি। ২০০৮ সালে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের বাজার ছিল ২৬ মিলিয়ন ডলার, ২০২১ সালে তা ১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এই সাফল্যগাঁথা একা সরকার কিংবা উদ্যোক্তাদের নয়, এই সাফল্যের অংশীদার আমি, আপনি আমরা সকলেই। অর্জনে অবশ্য স্থির হয়ে বসে থাকার ফুরসত নেই, এখনও যে অনেক পথ পাড়ি দেয়া বাকি। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নের বাস্তবায়নের পথ ধরে নিরন্তর অর্জনে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ।
এই লেখাগুলো মিস করবেন না যেন!
| ফ্রি ফেসবুক ব্যবহার করবেন যেভাবে
| স্তন ক্যান্সার নিয়ে কতটা জানেন?