মলনুপিরাভির : কোভিড চিকিৎসায় প্রথম খাওয়ার ট্যাবলেট | TmA

 


TmA Desk



করোনাভাইরাসের উপসর্গের চিকিৎসায় মুখে খাওয়ার প্রথম ওষুধটি যুক্তরাজ্যের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন পেয়েছে।কোভিডে সম্প্রতি আক্রান্ত ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের দিনে দুবার করে মলনুপিরাভির বড়ি সেবন করতে দেওয়া হয়েছে বলে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে।


মূলত সর্দি-জ্বরের চিকিৎসার জন্য তৈরি বড়িটি পরীক্ষামূলক প্রয়োগে আশা জাগানো ফলাফল দেখিয়েছে। এই বড়ি সেবনে হাসপাতালে ভর্তি বা মৃত্যুর ঝুঁকি অর্ধেক কমেছে বলে প্রমাণ মিলেছে।


দুই কোম্পানির যৌথ উদ্যোগ


মলনুপিরাভির একটি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ। যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টা শহরের একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় এমোরি পরিচালিত গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ড্রাইভ ২০০৩ সালে এমন একটি পদার্থের সন্ধান পায় যা কিনা বিভিন্নরকম আরএনএ (রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড) ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করবে। কিন্তু এটি মুখে খাবার যোগ্য ছিল না, এবং তারা দেখতে পান প্রাণীকোষে এর দ্বারা মিউটেশন ঘটতে পারে। ফলে সমস্ত তথ্য ডাটাবেসে রেখে তারা আর অগ্রসর হলেন না। এরপর কেটে গেছে এক দশক। ২০১৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি প্রতিষ্ঠান ডিফেন্স থ্রেট রিডাকশন এজেন্সি একটি আরএনএ ভাইরাসের কার্যকরী প্রতিষেধক প্রস্তাব করতে দরপত্র আহ্বান করে। উৎসাহিত ড্রাইভের গবেষকরা এবার তাদের তথ্যকেন্দ্র ঘেঁটে দশ বছর আগের সেই উপাদানের সন্ধান পেলেন। তারা এর রাসায়নিক গঠনে কিছু পরিবর্তন আনলেন। ফলে এটি পরিণত হলো প্রোড্রাগ নামে একটি বস্তুতে, যা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় মানবশরীরে প্রবেশ করে। পরবর্তীতে বিপাকক্রিয়ার মাধ্যমে এটি সক্রিয় হয়। এর সাংকেতিক নাম হয় EIDD-2801, যেটি এখন মলনুপিরাভির নামে পরিচিতি পেয়েছে। 


বিনামূল্যে এক হাজার কিডনী প্রতিস্থাপন! 


মলনুপিরাভির নিয়ে গবেষণায় দেখা যায় যে এটি বেশ কয়েক রকম আরএনএ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করতে সক্ষম। বিশেষ করে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের বিরুদ্ধে এর কার্যক্ষমতা নিয়ে উৎসাহব্যঞ্জক ফলাফল দেখা যায়।২০১৯ সালের শেষদিকে ইনফ্লুয়েঞ্জার উপর মলনুপিরাভির নিয়ে মানবদেহে পরীক্ষা চালাতে ড্রাইভের গবেষকেরা এফডিএ’তে আবেদন চূড়ান্ত করার পর্যায়ে ছিলেন। এমন সময় আঘাত হানল করোনাভাইরাস। করোনা ছিল আরএনএ ভাইরাস। ফলে ড্রাইভ কোভিডের উপর মলনুপিরাভিরের প্রভাব দেখতে সংকল্পবদ্ধ হলো।রিজব্যাক ড্রাইভের সাথে প্রথম ধাপের পরীক্ষা সম্পন্ন করে। এতে মানবশরীরে মলনুপিরাভিরের বৈশিষ্ট্য লিপিবদ্ধ করা হয়। পাশাপাশি এটাও সামনে আসে যে খারাপ কোনো প্রতিক্রিয়া মলনুপিরাভির সৃষ্টি করছে না।রিজব্যাক উপলব্ধি করল তারা একটি যুগান্তকারী আবিষ্কারের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। এজন্য আরো বৃহৎ আকারে তাদের গবেষণাকে সম্প্রসারণে তারা জোট বাঁধল ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি মার্ক সেরোনোর সাথে।মার্ক ও রিজব্যাক দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা শেষ করে ২০২১ সালের মার্চে একটি চিকিৎসা সংক্রান্ত সম্মেলনে ফলাফল উপস্থাপন করে। ১৭৫ জন কোভিড রোগীর উপর এই পরীক্ষায় মলনুপিরাভির প্রাথমিকভাবে করোনাকে ঘায়েল করতে সক্ষম বলে প্রমাণিত হয়।  



ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে কী দেখা গেছে? 


মার্ক এরপর তৃতীয় বা অনুমোদনের আবেদন দাখিলের চূড়ান্ত ধাপের পরীক্ষার তোড়জোড় শুরু করে। এর জন্য প্রায় হাজার তিনেক স্বেচ্ছাসেবী নেওয়ার কথা ছিল। এর মধ্য থেকে মলনুপিরাভিরের কার্যকারিতা যাচাইয়ে ৭৭৫ জন রোগীর ওপরে একটি গবেষণা চালায় মার্ক। সেখানে দেখা যায়, যেসব রোগীর চিকিৎসায় মলনুপিরাভির ব্যবহার করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে মাত্র ৭ দশমিক ৩ শতাংশকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। 


 অন্যদিকে যারা প্লাসেবো (ডামি পিল/ওষুধ নয়) নিয়েছে তাদের ১৪ দশমিক ১ ভাগকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। অন্যদিকে প্লাসেবো নেওয়া রোগীদের মধ্যে আটজনের মৃত্যু হলেও ‘মলনুপিরাভির’ নেওয়া রোগীদের কেউ মারা যায়নি।


ভাইরাসের জেনেটিক কোড-এ ত্রুটি সৃষ্টির বিষয়টি মাথায় রেখে এই ওষুধ তৈরি করা হয়েছে যাতে এটি শরীরে ছড়িয়ে পড়তে না পারে। এই ওষুধটি মূলত ইনফ্লুয়েঞ্জা চিকিৎসার জন্য উৎপাদন করা হয়।


নতুন এ ওষুধের সফলতার খবর অত্যন্ত খুশির বলে ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউসি। তবে পর্যালোচনার আগপর্যন্ত এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।


কতটা কার্যকর হবে মলনুপিরাভির? 


মলনুপিরাভির তৈরি করা হয়েছে এমনভাবে যা ভাইরাসের জেনেটিক কোডে পরিবর্তন আনবে।

পরীক্ষামূলক প্রয়োগে তাদের তৈরি ওষুধ মলনুপিরাভির মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকা কোভিড রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার বা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার হার ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনতে পারছে বলে প্রমাণ মিলেছে।ইতিবাচক ফলাফল পাওয়ায় নির্ধারিত সময়ের আগেই এ ওষুধের তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালের ইতি টেনেছে মার্ক।


করোনায় আক্রান্ত ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর ক্ষেত্রে মলনুপিরাভির বড়ি দিনে দুবার প্রয়োগ করতে হবে বলে জানা গেছে।


বিশ্বে প্রথমবারের মতো ইউনিসেক্স কনডম আবিষ্কার 


একজন রোগীর যখন কোভিড-১৯ ধরা পড়বে তখন মলনুপিরাভিরের কোর্স শুরু হয়ে যাবে। ২০০ মিলিগ্রামের চারটি ক্যাপসুল দিনে দু'‌বার করে পাঁচ দিন খেতে হবে, মোট ৪০টি ক্যাপসুল।


করোনার মুখে খাওয়ার ট্যাবলেট ব্যবহারিক দিক দিয়ে সুবিধা। কারণ ট্যাবলেট যে কোনও স্থানীয় ফার্মেসি বা ক্লিনিকে সহজেই সংরক্ষণ এবং বিতরণ করা যেতে পারে। ভ্যাকসিন এবং অ্যান্টিবডি থেরাপির সাথে তুলনা করলে ট্যাবলেট তৈরি করা সহজ এবং সস্তা।


বাজারে আসবে কবে? 


চলতি নভেম্বরের মধ্যেই যুক্তরাজ্য সরকার প্রথম দফায় এ বড়ির ৪ লাখ ৮০ হাজার কোর্স কিনতে সম্মত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো আরও কয়েকটি দেশ এ ওষুধ কেনার অর্ডার দিচ্ছে বলে জানা গেছে।


যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের মলনুপিরাভিরের ১৭ লাখ কোর্স ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে কেনার তথ্য পাওয়া গেছে। এই হিসেবে পাঁচদিনের এক কোর্সের দাম পড়ছে প্রায় ৭০০ মার্কিন ডলার।


যুক্তরাজ্যে একটি জাতীয় গবেষণামূলক কর্মসূচির আওতায় প্রাথমিকভাবে অ্যান্টিভাইরাল এই বড়ি করোনা টিকা নিয়েছেন বা নেননি—এমন উভয় ধরনের কোভিড রোগীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হবে। ঢালাওভাবে এটির প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এর কার্যকারিতা নিয়ে আরও তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করবে সরকার।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকতর কার্যকর ফল পাওয়ার জন্য করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে তাঁর লক্ষণ প্রকাশের পাঁচ দিনের মধ্যে এই বড়ি খাওয়াতে হবে।


যুক্তরাজ্যের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা এমএইচআরএ বলেছে, যাঁদের মৃদু থেকে মধ্যম ধরনের করোনা উপসর্গ রয়েছে ও জটিলতার মুখে পড়ার অন্তত একটি ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান, যেমন স্থূলতা, বেশি বয়স, ডায়াবেটিস বা হৃদ্‌যন্ত্রের অসুখ রয়েছে, তাঁদের ওপর এ ওষুধ প্রয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।


স্তন ক্যান্সার নিয়ে কতটা জানেন আপনি?


বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এরইমধ্যে ক্যাপসুলটি সংগ্রহে আলোচনা বা এ সংক্রান্ত প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে বলে জানা গেছে। এরমধ্যে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের অন্তত আটটি দেশ রয়েছে বলে জানা গেছে। ওষুধ বিশ্লেষক সংস্থা এয়ারফিনিটি জানিয়েছে, এই তালিকায় নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশ রয়েছে, যারা টিকাদান কর্মসূচি শুরু করতে বেশ বিলম্ব করেছিল।


অন্য কোম্পানির কী খবর? 


প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি রোশ ও ফাইজারও কোভিডের মুখে খাওয়ার ওষুধ তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত তারা কেবল অ্যান্টিবডি ককটেল তৈরি করতে পেরেছে, যা নিতে হয় শিরায় ইনজেকশনের মাধ্যমে।


তবে ০৫ নভেম্বর শুক্রবার টিকা প্রস্তুতকারী মার্কিন প্রতিষ্ঠান ফাইজার বলেছে, করোনা চিকিৎসায় ব্যবহৃত তাদের তৈরি করা বড়ি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ৮৯ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকারিতা দেখিয়েছে। ওষুধটির নাম প্যাক্সলোভিড। এটি ব্যবহারে অধিক ঝুঁকিতে থাকা প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বা মৃত্যুঝুঁকি ৮৯ শতাংশ কমে যায়।