মিনিকেট নামে কোনো চাল নেই! | TmA

 




বাজারের সবচেয়ে জনপ্রিয় চালের নাম মিনিকেট। ঝকঝকে, ঝরঝরে চিকন এই চালের দাম কিছুটা বেশি হলেও ক্রেতাদের প্রথম পছন্দ এই মিনিকেট চাল। কিন্তু অবাক করার ব্যাপার হল, বাংলাদেশ তো নয়ই, পৃথিবীতেই মিনিকেট নামে কোন ধানের জাতই নেয় অথচ বাজারে মিনিকেট চালের ব্যবসা চলছে রমরমা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি গবেষক দল সম্প্রতি দেশের ১০টি জেলা থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, দেশে মিনিকেট নামে কোনো ধান নেই। তাহলে মিনিকেট চালের নামে কী খাচ্ছি আমরা? 



মিনিকেট নামের উৎপত্তি কীভাবে?  


‘মিনিকেট’ শব্দটা এসেছে ইংরেজি শব্দ ‘মিনি’ ও ‘কিট’ থেকে। মিনিকিট আদতে কোনো ধানের ধরণ নয়। মিনিকিট হচ্ছে একধরনের প্রোগ্রাম, যেখানে ভারত সরকার দুই কেজি ধানের বীজের প্যাকেট কৃষকদের উপহার হিসেবে দিত। নতুন কোনো ধানের জাত আবিষ্কৃত হলে, সেটা কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয় করতে এই পদ্ধতির ভূমিকা অপরিহার্য। পরে অবৈধভাবে সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারত থেকে কিছু ধানের জাত বাংলাদেশে এসেছে। তখন ধানের মূল নামের পরিবর্তে ভারতীয় প্রোগ্রামের নামানুসারে বাংলাদেশে মিনিকেট নামের প্রচলন শুরু হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। 


ভারত সীমান্তের কুষ্টিয়া জেলার ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদ ঢাকার বাজারে মিনিকেট চালের বাণিজ্যিক প্রচলন ঘটিয়েছেন বলে ব্যবসায়ী মহলে প্রচলিত রয়েছে।



ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা কেন ৪০ বছর এফবিআইয়ের নজরবন্দী ছিলেন? 


তিনি বলছিলেন, “১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯০ সালের দিকে ভারত থেকে যশোরে এই ধানের বিস্তার হয়। পরে পাশের জেলাগুলোতেও ছড়ায়।"


কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ যশোর কার্যালয়ের উপপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাসও বলছেন, মিনিকেট নামটির সূত্রপাত হয়েছে ভারত থেকে আসা ধান থেকে।



মিনিকেট নামের হরেক রকম চাল 



দেশে মূলত তিন ধরণের ধানের ফলন হয়ে থাকে। এগুলো হল- আউশ, আমন ও বোরো। আর ধানের অর্ধেকেরও বেশি হলো বোরো জাতের, যেগুলোর পরিচিত ব্রি হিসেবে।


কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বলছে এ ব্রি ধানের দুটি জাত থেকেই বেশি ধান পাওয়া যায়। অথচ বাজারে ব্রি নামে কোন চাল নেই।


বর্তমানে যেসব চাল মিনিকেট নামে বিক্রি হচ্ছে, এসব আসলে বিদেশি কোনো চাল নয়। বরং যেকোনো দেশীয় জাতের মোটা চালকে ঘষেমেজে চকচকে ও স্লিম করে মিনিকেট নামে বিক্রি করা হয়। মূলত বিআর-২৬, বিআর-২৮, বিআর-৩৩, ব্রি-৪৩, ৪৮ থেকে ৯৮ পর্যন্ত উদ্ভাবিত বিভিন্ন জাতের ধান এবং কল্যাণী, স্বর্ণা, গুটিস্বর্ণা, লাল স্বর্ণা, আইআর-৫০, জাম্বু ও কাজললতা ধানের চালকে মিনিকেট চাল হিসেবে চালানো হচ্ছে। এসব ধানের চালকে মিল পর্যায়ে গ্রেডিং ও মিক্সড গ্রেডিংয়ের মাধ্যমে পলিশ করে চকচকে করা হয়।


 বাজারে ব্রাউন ও মোটা চালের চাহিদা অনেক কম থাকার কারণে মিল মালিকদের অতিরিক্ত দুটি যন্ত্র কিনতে হয় এই মোটা চালকে সরু করার জন্য। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের ফলিত গবেষণা বিভাগের প্রধান ড. মোঃ হুমায়ুন কবীর বলছেন, ইন্সটিটিউটের উদ্ভাবিত ব্রি ২৮ ধানকেই মিলগুলো নিজেদের ইচ্ছে মতো কেটে, মিক্স ও ওভারপলিশ করে নানা নামে বাজারে আনছে।



ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ আব্দুর রউফ সরকার বলছেন, প্রডাকশন ও ব্রান্ডিং দুটি আলাদা হয়ে গেছে কোন কোন ধানের ক্ষেত্রে আর সেটিই কিছু চালের নামকরণের ক্ষেত্রে বিপত্তি তৈরি করেছে।


"ধান থেকে চাল হওয়ার পর সেটি ব্রান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে কোন নীতিমালা নেই। সে কারণে অনেকে নিজের ইচ্ছে মতো চালের নামকরণ করেছে এবং কিছু নাম সেভাবেই প্রচলন হয়ে গেছে," বলছিলেন তিনি।



সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, মিল মালিকেরা ব্রি-২৮ এবং ব্রি-২৯ জাতের ধান থেকে পাওয়া চাল দিয়ে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চাল তৈরি করছেন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে এই দুটি জাতের ধানই সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়। সাধারনত ৪০ টাকা কেজি দরে এই চাল বিক্রি হয়। অন্যদিকে, বাজারে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালের দাম ৫৫ টাকা থেকে ৬০ টাকা কেজি।


মিনিকেট চাল নিয়ে খোঁজখবর ও গবেষণার জন্য গত কয়েক বছরে সরকার বেশকিছু কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু চালের এই অসাধু ব্যবসা বন্ধ করা আজও সম্ভব হয়নি।


দেশে মোট ১৯ হাজার ৭৩৪টি চালকল আছে। এর মধ্যে ছোট পরিসরে আন্তজেলা বাণিজ্য পরিচালনাকারী সহস্রাধিক চালকল বিভিন্ন চিকন জাতের ধানকে চাল বানিয়ে মিনিকেট ব্র্যান্ড নাম দিয়ে বাজারে ছাড়ে। এ বাণিজ্যে অটোরাইস মিলারদের দাপট এখন দেশব্যাপী। এখন মিলারদের নামেও মিনিকেট ব্র্যান্ডিং হচ্ছে। বিশেষ করে রশিদ, মোজাম্মেল, বিশ্বাস, সাকি, ডলফিন, জোড়া কবুতরসহ আরও অনেক ব্র্যান্ড বাজারে মিনিকেট চাল সরবরাহ করে আসছে।



কীভাবে হয় কারসাজি? 


দেশে মিনিকেটের সবচেয়ে বড় জোগানদাতা রশিদ এগ্রোর প্রতিষ্ঠাতা রশিদ এ বিষয়ে বলেন, “আমরা যারা হাস্কার, আমরা প্রথমে ধানের উপর থেকে খোসা ছাঁটাই করি। তারপরে এটাকে হোয়াইটনারে দিয়ে সাদা চকচকে করি। বাজারের চাহিদার কারণে আমরা বাড়তি প্রযুক্তি ও শ্রম ব্যবহার করে চালকে আরও উজ্জ্বল করে থাকি।”


নওগাঁর একজন মিল মালিক বলছেন, তারা কৃষকের কাছ থেকে ধান নিয়ে সেটি একবারেই অটোমেটিক ড্রায়ার মিলে দেন।




এগুলো তাপে সেদ্ধ হয়ে কালার সর্টার যন্ত্রের মধ্য দিকে ঝকঝকে চাল হিসেবে বের হয়ে আসে।


পরে পানি মিশিয়ে আরও তাপ দিয়ে চালের উপরের আবরণ তুলে ফেলা হয়। এরপর আবার মেশিনে পলিশ করা হয়।


এভাবে চালের প্রকৃত রংসহ উপরিভাগের আস্তরণ ও ময়লা সরিয়ে ঝকঝকে চাল বের হয়ে বাজারে যায় মিনিকেট, নাজিরশাইল কিংবা কাজললতা নামে। 


খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি সংস্থা, খাদ্য পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ ইউনিট (এফপিএমইউ) ২০২০ সালে একটি জরিপ চালায়। জরিপে দেখা যায়, আধুনিক অটো রাইস মিলের মালিকেরা মেশিনের মাধ্যমে চালের আকার পরিবর্তন করেন এবং পলিশ করে চালকে চকচকে রূপ দেন। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় 'রাইস মিলিং'।


এর ফলে কোন চাল কোন ধান থেকে আসছে তা বোঝার কোনো উপায় থাকে না ক্রেতার।





পুষ্টিতে হেরফের? 


গবেষকরা বলছেন, ধানের পুষ্টিমানের নাটকীয় পরিবর্তন হয় মেশিন কাটাকাটি আর পলিশ করার কারণে।


এ বিষয়ে করা এক গবেষণা বলছে "ওভার পলিশ ও বেশি ছাঁটাইয়ের কারণে জিংকের পরিমাণ অনেক কমে যায়। এছাড়া কিছু কিছু ধানের পুষ্টি উপাদান নাটকীয় কমে যায় এবং কোন কোন চালে শুধু শর্করাই থাকে"।


মূলত ধান থেকে বের হওয়া চাল সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত ছাঁটাই করলে পুষ্টিমানের ক্ষতি হয় না কিন্তু সূত্র বলছে, বাংলাদেশে ছাটাই করা হয় ২৫ শতাংশেরও বেশি।


ধানের খোসা ছাড়ানোর পর বেশি ঘষে কমিয়ে ফেলা চাল খেলে তাতে ক্ষতিকর হয় কি না, সে প্রশ্ন করা হয়েছিল ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে কর্মরত বাংলাদেশি চিকিৎসক তাসনিম জারার কাছে।


তিনি বলেন, “মিলগুলোতে অধিক পরিমাণে ঘষে ফেলার ফলে চালে ভিটামিন, মিনারেল ও ফাইবারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদন কমে যায়, সেখানে কার্বোহাইড্রেটের বড় একটা অংশ অবশিষ্ট থাকে। মেশিনে চালকে ঘষামাজা করে সরিয়ে দেওয়া ফাইবার কোলস্টেরল স্বল্পতা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়তা করতে পারে।


“গবেষণায় দেখা গেছে- অধিক পরিশোধিত চাল স্থূলতা, ডায়বেটিস ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। আর এভাবেই যেটা পুষ্টির একটা বড় জোগান হতে পারত, সেটা হয়ে যায় স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ।”


চালকে সাদা ও স্লিম করার কারণে আমরা গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিনস, খনিজ ও আঁশ হারাচ্ছি। আঁশের পরিমাণ কম থাকার কারণে পরিপাকে খুব তাড়াতাড়ি শর্করা ভেঙে উৎপন্ন চিনি রক্তে চলে যায়। এ কারণে সাদা চালের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স অনেক ওপরে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, সাদা চাল গ্রহণ টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে ব্রাউন চাল দৈনিক আঁশের চাহিদার প্রায় এক–সপ্তমাংশ পূরণ করতে সক্ষম।



ডেনমার্কের খাদ্য গবেষক ড. মো. নাহিদুল ইসলাম বলছেন, শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় সেলেনিয়ামের প্রায় এক–চতুর্থাংশের জোগান হতে পারে ব্রাউন চাল থেকে। তাই ব্রাউন চাল শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। হার্টের সমস্যা, ক্যানসার, গলগণ্ড রোগ, অ্যাজমার প্রকোপ কমাতে সাহায্য করে। সর্বোপরি শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে। এ ছাড়া দৈনিক ম্যাংগানিজের চাহিদার প্রায় ৮৮ শতাংশ পূরণ করতে পারে ব্রাউন চাল।


চাল থেকে প্রোটিন বা আমিষও পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম চালে আমিষ থাকে প্রায় ৬-৭ শতাংশের মতো। কিন্তু কলে ছাঁটার কারণে ১-২ শতাংশ প্রোটিন নষ্ট হয়ে যায়। সবচেয়ে ক্ষতিকর হলো ফ্যাট বা অয়েল কমে যাওয়া। অয়েল কমে যায় ৬২ শতাংশ, ক্রুড ফাইবার কমে ৪০ শতাংশ এবং অ্যাশ কমে ১১৮ শতাংশ। এ ছাড়া ভিটামিন বি-১, বি-৬ প্রায় ৮০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়।



আপনিই সিদ্ধান্ত নিন, পেট মোটা ব্রাউন চাল খেয়ে স্লিম হবেন, নাকি মিনিকেট চাল খেয়ে নিজের পেট বাড়াবেন? 



আরো পড়ুন : 

১। জন্মদিন পালনে ইসলাম কী বলে?

২। ঈদে মিলাদুন্নবী নিয়ে যা জানতেই হবে

৩। স্বপ্নে কী এমন ভয়ংকর শাস্তি দেখেছিলেন রাসূল (সা.)? 

৪। সালামের সঠিক নিয়ম না জেনে গুনাহ করছেন?

৫। ফেসবুকে মেয়েদের ছবি দেখার আগে সাবধান