ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা কেন ৪০ বছর এফবিআইয়ের নজরবন্দী ছিলেন? | TmA

 

Written by : Tanvir Mahatab Abir


মার্কিন গায়ক, অভিনেতা ও প্রযোজক ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী সঙ্গীতশিল্পী। তিনি সর্বকালের সর্বাধিক বিক্রিত সঙ্গীতশিল্পীদের একজন, বিশ্বব্যাপী তার ১৫০ মিলিয়নের অধিক রেকর্ড বিক্রি হয়েছে। শুধু গানই নয়, বিশ্বজোড়া তাঁর পরিচয় ছিল খ্যাতিমান অভিনেতা হিসেবেও। শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা বিভাগে একাডেমি পুরস্কার ও গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার তাঁর অভিনয় প্রতিভারই জানান দেয়। কিন্তু এই অভিনেতাকে দীর্ঘ ৪০ বছর এফবিআইয়ের নজরবন্দী হয়ে থাকতে হয়েছিল। তাঁর চলাফেরার উপর প্রতিনিয়ত নজর রাখা হতো। কী কারণে ছিল এমন নজরদারি? এমন খ্যাতিমান অভিনেতার জীবন কি তবে রহস্যের জালে ঘেরা ছিল? 


একজন ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা 


তাঁর পুরো নাম ছিল ফ্রান্সিস আলবার্ট সুনাত্রা। তবে ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা নামেই তিনি ছিলেন সর্বাধিক পরিচিত। জন্ম ১৯১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর,  নিউ জার্সির হোবোকেনে। অভিবাসী পরিবারের একমাত্র শিশু সন্তান সিনাত্রার গানের প্রতি দুর্বলতা তরুণ বয়সেই। ত্রিশের দশকে মধ্যভাগে সে সময়ের বিখ্যাত আমেরিকান গায়ক বিং ক্রসবির গান শুনে সিনাত্রারও গায়ক হওয়ার স্বাদ জাগে। হাইস্কুল ছাত্র সিনাত্রা অবশ্য এর আগে থেকেই স্কুলের গ্লি ক্লাবের সদস্য ছিলেন, স্থানীয় নাইটক্লাবগুলোতে করতেন গানও। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে একক সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে নিজেকে বেশ পরিচিত করে তোলেন সিনাত্রা। ১৯৪৩ সালে প্রথম অভিনয় জগতে বিচরণ ঘটে সিনাত্রার। সে বছর রিভেইলী উইথ বেভারলি সিনেমার মাধ্যমে অভিনয়ে নাম লেখান তিনি। অভিষেকের বছর দশেকের মাথায় ১৯৫৩ সালে সিনাত্রা ফ্রম হিরো টু ইটারনিটি সিনেমার জন্য অস্কার পুরষ্কার লাভ করেন। এমন করেই গান ও অভিনয়ের সাফল্যগাঁথায় নিজেকে উদ্ভাসিত করার প্রয়াস চলতে থাকে ফ্রাঙ্ক সিনাত্রার। 



বিনোদন ছাড়িয়ে মিশ্র এক জীবন


সিনাত্রা তাঁর জীবনের গল্পে অনেক উত্থান পতন দেখেছেন। দেখেছেন নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়াটাও। গানকে যেমন ভালোবেসে গেছেন তিনি, করেছেন অভিনয়কেও আপন। ১৯৪৩ সালে যখন অভিনয় জগতে পা রাখেন সিনাত্রা,  সে সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। তিনি চেয়েছিলেন সে যুদ্ধে অংশ নিতে। কিন্তু কানের পর্দা ছিড়ে যাওয়ায় তা আর সম্ভব হয়ে উঠে নি। পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে তাঁর কাছে ধাক্কা হয়ে আসে বেশ কিছু সিনেমার চুক্তি ভঙ্গের খবর। এরপরও ১৯৫৩ সালে তিনি সমহিমায় নিজেকে চেনান অস্কারের মঞ্চে সাফল্যগাঁথা এঁকে। 


সত্তরের দশকে সিনাত্রাকে রাজনীতিতে ঝুঁকতে দেখা যায়। সে সময় ব্যবসায় কিংবা বিনোদন জগত থেকে রাজনীতির ময়দানেই বেশি সময় দিতে দেখা যেত তাঁকে। জন এফ কেনেডি,  রিচার্ড নিকসন, রোনাল্ড রিগ্যানের মতো রাজনীতিবিদদের সাথে নিয়মিত উঠাবসা ছিল সিনাত্রার। 




এফবিআইয়ের নজরে কীভাবে? 


সিনাত্রার বয়স যখন ২৩ বছর তাঁকে প্রথম কারাবরণ করতে হয়েছিল। প্রলোভনের অপরাধের শিকার হয়ে ঘটা এই ঘটনা থেকে তাঁর বিখ্যাত মুখের ছবিটি এসেছিল। সিনাত্রার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি একজন সুনামসম্পন্ন মহিলাকে তার সাথে যৌনমিলন করতে প্রভাব খাটিয়ে রাজি করেছিলেন। এই অভিযোগ অবশ্য পরে আমলে নেয় নি বিচার বিভাগ। কারণ সন্দেহভাজন সেই মহিলা বিবাহিত ছিলেন। 


তবে ঝামেলা বাদে এর কিছুদিন পর, যখন সিনাত্রা আবার গ্রেফতার হন। এইবার তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল গুরুতর। ব্যভিচার করার অপরাধ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে।  অভিযোগ থেকে মুক্তি পেতে তিনি স্ট্যাম্পে সই করেন এবং পরবর্তীতে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান। 


সিনাত্রার বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলো একেবারেই তরুণ বয়সে এসেছিল। সে সময় খ্যাতির পথেও পা মাড়ান নি তিনি। এই দুই অভিযোগ পুলিশের খাতায় সিনাত্রাকে পরিচিত করে তুললেও এফবিআইয়ের সাথে তখনও কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না তার। 


এফবিআই সিনাত্রার উপর নজরদারি শুরু করে মাফিয়া ইস্যুতে সিনাত্রার সংশ্লিষ্টতার সূত্রে। সে সময় শিকাগোর বিখ্যাত মাফিয়া স্যাম গিয়ানসানার সাথে সিনাত্রার বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। সিনাত্রা গিয়ানসানা ও তার বান্ধবীকে জন এফ কেনেডির সাথে পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছিলেন। 


তবে সিনাত্রাকে নিয়ে লেখা ক্রিস রজেকের একটি বইয়ে দাবি করা হয়েছে, এফবিআই প্রথম সিনাত্রার সম্পর্কে আগ্রহ দেখায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাঁর অংশ না নেয়ার ব্যাপারটিতে। বইটিতে দাবি করা হয়েছে, সিনাত্রা সে সময় এক ডাক্তারকে আনফিট সার্টিফিকেট প্রদানের জন্য ৪০ হাজার ডলার দিয়েছিলেন। যদিও এফবিআই পরে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছিল। সংস্থাটি জানায়, সিনাত্রার কানের পর্দা ফেটে যাওয়া এবং মানসিক বিষয়গুলো বৈধ বলেই মনে হয়েছিল তাদের। 







কী ছিল এফবিআইয়ের ফাইলে? 


১৯৪৩ থেকে ১৯৮৫ - এই ৪৩ বছরে এফবিআইয়ের মোট ৩০ টি ফাইল প্রকাশিত হয় সিনাত্রা বিষয়ে। এফবিআইয়ের ফাইলগুলোয় উঠে এসেছে নজরদারির বিষয়ে এফবিআইয়ের বিশ্লেষণ,  পর্যবেক্ষণ এবং নিজেদের অবস্থান।  


এফবিআই সূত্র বলছে, সিনাত্রার সাথে মেলামেশা ছিল সে সময়কার ডেট্রয়েট মাফিয়া এন্থনী এবং ভিটো গিয়াকালোনের। 


এফবিআইয়ের সাবেক কর্মকর্তা স্যাম রুফিনো জানিয়েছেন,  গিয়াকালোনে বছরে বেশ কয়েকবার বিমানবন্দর থেকে সিনাত্রাকে রিসিভ করে নিয়ে যেতেন। তার দাবি, মাফিয়া ও খুনিদের সাথে উঠাবসায় সিনাত্রার কোনো ভয়ডরই ছিল না। 



সত্যিই কি ছিল মাফিয়াদের সাথে যোগাযোগ?  


মাফিয়াদের সাথে সিনাত্রার যোগাযোগ এবং আন্ডারওয়ার্ল্ড ঘনিষ্ঠতা নিয়ে পরিষ্কার কোনো তথ্য কখনোই জনসম্মুখে আসে নি। সিনাত্রা বিষয়ে এফবিআইয়ের ফাইলেও সে যুগের অপরাধের খতিয়ান সম্পর্কে বর্ণনা ছিল। তবে সিনাত্রার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে এফবিআই বরাবরই আড়ালে রাখতে চেয়েছিল নিজেদের। সিনাত্রা নিজেও বেশ কয়েকবার মাফিয়া সংযোগ বিষয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন। প্রতিবারই নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন এই গায়ক ও অভিনেতা। 


কেনেডির সাথে গিয়ানসানার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, এটি শুধুই ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্টের কাছে ইউনিয়ন ভোট প্রদানের প্রয়াসের অংশ ছিল। 


যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম সিবিএস নিউজকে ২০০০ সালে একটি সাক্ষাৎকার দেন সিনাত্রার কনিষ্ঠ কন্যা টিনা সিনাত্রা। সাক্ষাৎকারে টিনা জানান, মাফিয়াদের সাথে তার বাবার যোগাযোগ ছিল। ১৯৬০ সালে ইউনিয়ন ভোটে মাফিয়া ডন গিয়ানসানার সাথে কেনেডির যোগাযোগ করাতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় ছিলেন সিনাত্রা। টিনার দাবি, কেনেডিই আগ্রহেই গিয়ানসানাকে তার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন সিনাত্রা। পরবর্তীতে গিয়ানসানার বান্ধবী ক্যাম্পবেল এক্সনারই মধ্যস্থতাকারীর কাজ করেন। এমনকি কিউবা নেতা ফিদেল কাস্ট্রো হত্যার ষড়যন্ত্রেও এই যোগাযোগের সূত্র ছিল বলে দাবি খবর বেরিয়েছিল।  



সিনাত্রাকে প্রায়ই অপরাধ চক্র এবং পুলিশের মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টে নাম আছে এমন লোকদের সাথে প্রকাশ্যেই চলতে দেখা যেত। এফবিআইও সেই তথ্য উল্লেখ করেছে। মাফিয়ারা তাঁর দুর্বলতা জানতো। এজন্য জুয়া, নারী ও টাকার অফার দিয়ে তাঁর কাছ থেকে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা ছিল তাদের। তাদের দেখা হতো ক্যাসিনো কিংবা নাইটক্লাবে। 




এফবিআই কেন ব্যবস্থা নেয় নি? 


এফবিআই দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন যুগ ধরে সিনাত্রার গতিবিধির উপর নজর রেখে গেছে। তাঁর সম্পর্কে অকাট্য তথ্য প্রমাণসহ ফাইল প্রস্তুত করা হলেও কখনোই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনে নি সংস্থাটি। এমনকি তাকে কখনোই আমেরিকা বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গঠিত কমিশনের সামনে হাজির হতে হয় নি। 


এফবিআই তাঁকে কমিউনিজমের সাথে সম্ভাব্য সম্পর্কযুক্ত সন্দেহজনক হিসেবেই মনে করেছিল। অন্তত এফবিআইয়ের ফাইলে এমন তথ্যই দেওয়া আছে। ফাইলগুলোয় বর্ণবাদ বিরোধী উদ্যোগের সমর্থন থেকে শুরু করে কমিউনিস্ট বলে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রতিরক্ষা পর্যন্ত তথ্য দেওয়া হয়েছে। এফবিআইয়ের ফাইলগুলো এটাই প্রমাণ করে যে, তৎকালীন সময়ে সিনাত্রাকে নিজেদের জন্য হুমকি মনে করেছিল সংস্থাটি। তাই সম্ভাব্য সকল বিষয় মাথায় রেখেই তাঁর উপর নজর রাখতে বাধ্য হয়েছিল এফবিআই।  



সিনাত্রা নিজেও জানতেন এফবিআই তথা সরকার তাঁর গতিবিধির উপর নজর রাখছে। ১৯৮০ সালে তাঁর অনুরোধে এফবিআই তাঁর কাছে তাদের ফাইলগুলোর কপি পাঠায়। 


১৯৯৮ সালে হার্ট অ্যাটাক করে লস এঞ্জেলসে মারা যান এই গায়ক ও অভিনেতা।