করতেন সরকারি চাকরি। ডাক্তারি পেশায় চেয়েছিলেন কিডনী রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে। কিন্তু সরকারি হাসপাতালের নানান সীমাবদ্ধতা তাকে গন্ডির বাইরে যাওয়া থেকে আটকে রেখেছিল। কিন্তু ইচ্ছার কাছে কি আর কিছু আটকে থাকতে পারে! ছেড়ে দিলেন সরকারি চাকরি। প্রতিষ্ঠা করেন কিডনি হাসপাতাল।সরকারি চাকরি করে যে অর্থ তিনি আয় করেছিলেন, সেই সঞ্চিত অর্থ দিয়ে তিনি বাড়ি-গাড়ি না করে কিডনি রোগীদের কথা ভেবে কিনেছিলেন ডায়ালাইসিস মেশিন।বিনা পারিশ্রমিকে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৭টি কিডনি প্রতিস্থাপন করে ইতোমধ্যে আলোচনায় এসেছেন তিনি। দরিদ্র মানুষের শুধু কিডনি প্রতিস্থাপনই করে দেননি তিনি, একই সঙ্গে কিডনির সক্রিয়তা নিশ্চিতকরণে বিনা পয়সায় মাসিক ফলোআপ করে আসছেন।
একজন ডাক্তার কামরুল
আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের সাবেক কর্মকর্তা ও ঈশ্বরদীর আমিনপাড়া গ্রামের আমিনুল ইসলাম আমিনের মেজো সন্তান কামরুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাবা আমিনুল ইসলাম পাকশী ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার 'অপরাধে' স্থানীয় রাজাকার ও বিহারীরা তাকে হত্যা করে।কামরুল ১৯৮০ সালে ঈশ্বরদী উপজেলার চন্দ্র প্রভা বিদ্যাপীঠ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ১৩তম স্থান অর্জন করেন। এরপর উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। সেখানেও মেধা তালিকায় দশম স্থান অর্জন করেন। ১৯৮২ সালে তখনকার ৮টি মেডিকেল কলেজের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় ১ম স্থান অর্জনের পর তার উচ্চশিক্ষা জীবন শুরু হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজে।
অযুর সঠিক নিয়ম জানেন তো?
ঢাকা মেডিকেল থেকে পাশ করার পর একাদশ বিসিএসে ১৯৯৩ সালে স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগদান করেন কামরুল। প্রথমে তিনি ঢাকা মেডিকেলে যোগদান করেন।
পরবর্তীতে কামরুল ইউরোলজিতে ৫ বছর মেয়াদি এমএস প্রোগ্রাম সম্পন্ন করেন এবং জাতীয় কিডনি ও ইউরোলজি হাসপাতালে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ২০০৭ সালে সফলভাবে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট শুরু করেন তিনি। সরকারি হাসপাতালের নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি ২০১১ সালে সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে শ্যামলীতে নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেন কিডনি হাসপাতাল। ডাক্তার কামরুল ৩ কন্যা সন্তানের জনক।
কামরুলের হাসপাতালে
অধ্যাপক কামরুল ইসলাম ২০১৪ সালে অসহায় রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে ঢাকায় সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস (সিকেডি) অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। শ্যামলির ছয়তলার একটি সাদামাটা ভবনে চলছে এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। করোনা মহামারি শুরুর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বারডেম, কিডনি ফাউন্ডেশন ও সিকেডি হাসপাতালে নিয়মিত কিডনি প্রতিস্থাপন করা হতো। নিয়মিত না হলেও জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, এভারকেয়ার হাসপাতাল, পপুলার হাসপাতাল ও ল্যাবএইড হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হতো।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক প্রতিবেদন অনুসারে, কিডনি জটিলতায় দেশে ২০১৯ সালে যত মানুষ মারা গেছেন, তার প্রায় ৩ গুণ মানুষ মারা গেছেন ২০২০ সালে। অর্থাৎ করোনা মহামারির মধ্যে। এর পেছনে অবশ্য কারণও ছিল।
মহামারি শুরু হলে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে কিডনি প্রতিস্থাপন বন্ধ হয়ে যায়। গণস্বাস্থ্য কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার ছাড়া যখন সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিসসহ কিডনি রোগীদের সেবা বন্ধ ছিল, তখনও সিকেডি হাসপাতাল তার স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে গেছে।
জানা যায়, করোনা মহামারির মধ্যে গত বছরের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত অধ্যাপক কামরুল ও তার ১২ সদস্যের দল আড়াই শতাধিক কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন।
সিকেডি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, অধ্যাপক কামরুল ও তার দল এ পর্যন্ত যে ১ হাজার ৪টি কিডনি প্রতিস্থাপন করেছে, তার মধ্যে মাত্র ৭টি কিডনি কাজ করেনি। প্রতিস্থাপনের পর বিকল হয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ। অর্থাৎ সফলতার হার ৯৬ শতাংশ।
এ ছাড়া, মহামারির মধ্যে কিডনি প্রতিস্থাপনের পর করোনা আক্রান্ত হয়ে ২ জন মারা গেছেন। আর কিডনি প্রতিস্থাপনের ২ দিন পর হার্ট অ্যাটাক হয়ে মৃত্যু হয়েছে ১ রোগীর।
বিশ্বের প্রথম ইউনিসেক্স কনডম আবিষ্কার
বর্তমানে এই হাসপাতালে প্রতি সপ্তাহে ৪টি করে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। যা দেশের অন্য যে কোনো হাসপাতালের তুলনায় বেশি। এই হাসপাতালে ২ লাখ ১০ হাজার টাকার প্যাকেজ মূল্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। এই সেবায় ১৫ দিনের প্যাকেজের মধ্যে আছে ২ জনের অস্ত্রোপচার খরচ (রোগী ও ডোনার), বেড ভাড়া ও ওষুধ খরচ।সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এর চেয়ে কম খরচে দেশের বেসরকারি কোনো হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয়। পাশের দেশ ভারতেও কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য খরচ হয় ১৫ লাখ টাকার বেশি। এছাড়া সিকেডি অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে আনুষঙ্গিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচও তুলনামূলক কম। কিডনি প্রতিস্থাপনের আগে ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হলে সিকেডি হাসপাতালেই তার ব্যবস্থা আছে। আছে ২২ বেডের একটি ডায়ালাইসিস ইউনিট। খরচ দেড় হাজার টাকা। আইসিইউ শয্যার খরচ ৭ থেকে ৯ হাজার টাকার মধ্যে।
কতটা কঠিন ছিল কামরুলের পথচলা?
বিনা পারিশ্রমিকে হাজারের বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন ডাক্তার কামরুল ইসলাম। কিন্তু তার সাফল্য একদিনে আসেনি। এর পিছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের অনুশীলন। বিবিসিকে ডাক্তার কামরুল বলছিলেন, বাংলাদেশে কোরবানির দিন যখন খাসি-গরুর কোরবানি চলে, তখন তাদের কিডনি এনে অপারেশন থিয়েটারে বসতাম। কীভাবে তা সেলাই করা যায়, দিনের পর দিন তা প্র্যাকটিস করতাম। সেলাই করার পর দেখতাম, ধমনী, শিরা কেমন থাকে। এরপরের ভাবনা ছিল, মানুষের কিডনি প্রতিস্থাপন করা। ভাবনা থেকেই এল সাফল্য।
তবে কর্মজীবনের শুরুতে এই সার্জারির দিকে আগ্রহ ছিল না তার।তখন এফসিপিএস করে এসেছেন, ইউরোলজি করছেন। তাই এ কাজেই থাকার ইচ্ছা ছিল।
কামরুল ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে চাকরি পেলেন তখন এটিই হয়ে উঠলো তার কাজ। ইচ্ছাও তাই দমন করলেন। ২০০৫ সাল থেকে নিজ উদ্যোগে কিডনি রোগীদের চিকিৎসা শুরু করেন কামরুল। চারটি মেশিন নিয়ে ডায়ালিসিস সেটআপ তৈরি করেন। ২০০৭ সালের শুরুতে দুই মাসের মাথায় দেখা যায় ৩০ জন রোগী নিয়মিত ডায়ালিসিস করছেন।
কামরুল বলেন, তখন আমি ঠিক করলাম, অপারেশন থিয়েটার ও একটা আইসিইউর মত সেটআপ তৈরি করবো। সেটআপ তৈরি করে একজন রোগীকে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করার প্রস্তাব দিলাম। রোগীও রাজি হয়ে গেল। আমার কাছে তার রাজি হওয়াটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রথমবারই সাফল্য পেলাম।
বিনা পারিশ্রমিকে কিডনী প্রতিস্থাপন
চিকিৎসক অধ্যাপক কামরুল ইসলাম বলছিলেন, এ পর্যন্ত তার হাসপাতালে মোট ১ হাজার ৪টি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। কিডনি প্রতিস্থাপন করা সব রোগীর ফলোআপ পরীক্ষা করা হচ্ছে বিনামূল্যে। প্রতি মাসে এখানে অন্তত পাঁচ শতাধিক রোগী আসেন ফলোআপ পরীক্ষার জন্য। তাদের সবার ফলোআপ বিনামূল্যে করানো হয়।তাতে রোগী প্রতি পরীক্ষার খরচ আসে ৫০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা। এমনকি রিপোর্ট দেখতে কোনো ফি নেওয়া হয় না।
ন্যূনতম নির্ধারিত খরচ বাদে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য বিশেষজ্ঞ সার্জনের কোনো ফি নেন না অধ্যাপক কামরুল ইসলাম। রোগীদের ফলোআপ পরীক্ষার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে পরীক্ষা-নীরিক্ষার খরচ ও রিপোর্ট দেখার খরচও নেন না তিনি। খরচ কমাতে কিডনি সংরক্ষণের জন্য বিদেশ থেকে আমদানি করা এক ধরনের দামি তরলের বিকল্প তৈরি করেছেন তিনি। এভাবে নিজ পেশার মাধ্যমে সমাজের নিম্ন আয়ের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতি মানবিকতা ও দায়িত্বশীলতার অনন্য নজির স্থাপন করে চলেছেন এই অধ্যাপক।
কামরুল ইসলাম বলেন, 'এই ফলোআপের কারণে রোগীর কিডনি অনেক দিন সুস্থ থাকে। যদি ফলোআপ পরীক্ষার জন্য টাকা নেওয়া হতো, তাহলে রোগীদের বড় একটি অংশ কিডনি প্রতিস্থাপনের পর ফলোআপ পরীক্ষা করতে আসতেন না। তাতে অনেকেরই কিডনি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকতো।'